আমরা সাধারণত নামাজের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু দোয়া ছাডা এর বেশী কিছু জানি না বা পড়ি না। আমাদের স্থানীয় ইমাম, মোয়াজ্জিনগণ বা মাওলানাগণ এর বেশী কাউকে কিছু বলেন না বা শিক্ষা দেন না। কিন্তু সালাতের মধ্যে উল্লেখিত দোয়াগুলো ছাড়াও সেজদাহ্ রয়েছে আল্লাহ তাআলার কিছু প্রশাংসামূলক বাক্য। যার পঠনে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি সহজেই পাওয়া যায়।পুরো নামাজটিই যেহেতু এক প্রকার দোয়া আর রাসুল (সাঃ) যখনই কোনো সমস্যার সম্মুখিন হতেন বা কোনো বিপদ দেখলেই তিনি নামাজ আদায় করতেন এবং সমস্যার ধরণ অনুযায়ী তিনি দোয়া করতেন। তাই রাসুল (সাঃ) নামাজের মধ্যে যে যে স্থানে উল্লেখিত দোয়াগুলো পড়তেন সেগুলো আমরা অনুসরন করবো।
নামাজের সিজদার দো‘আ সমূহঃ |
সেজদাহ্ ইচ্ছাধিনভাবে তিনবার “সুবহা-না রব্বিয়াল আ‘লা’’ অথবা একবার ” সুবহানা রবিবয়াল আ‘লা ওয়া বিহামদিহি” বলা উত্তম, তবে যে কোন যিকির বলা যেতে পারে; আর এহতিয়াতে ওয়াজিবের ভিত্তিতে উক্ত দু‘টির যে কোন একটির সমপরিমাণ বলা উচিৎ। সেজদাহ্ যিকির একাধারে ও সহীহ আরবী ভাষায় বলতে হবে; আর তিনবার, পাঁচবার অথবা সাতবার বলা মুস্তাহাব।
১.দো‘আঃ
سُبْحَانَ رَبِّيَ الأَعْلَى
উচ্চারণ : “সুবহা-না রব্বিয়াল আ‘লাʼʼ।
অর্থ : “আমার রব্বের পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করছি, যিনি সবার উপরে।”
অথবা উচ্চারণ :” সুবহানা রবিবয়াল আ‘লা ওয়া বিহামদিহি”।
অর্থ: “আমার মহান রব্বের প্রশংসাপূর্ণ পবিত্রতা বর্ণনা করছি”।
[মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, নাসাঈ/আবু দাউদ, দারা কুতুনী, আহমাদ, ত্ববারানী ও বাইহাকী।]
২.দো‘আঃ
سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ، اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي
উচ্চারণ : “সুবহা-নাকাল্লা-হুম্মা রব্বানা ওয়া বিহামদিকা আল্লা-হুম্মাগফির লী”।
অর্থ : “হে আল্লাহ! আমাদের রব্ব! আপনার প্রশংসাসহ আপনার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে মাফ করে দিন।”
[বুখারী, নং ৭৯৪; মুসলিম, নং ৪৮৪; মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ]
৩.দো‘আঃ
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِرِضَاكَ مِنْ سَخَطِكَ، وَبِمُعَافَاتِكَ مِنْ عُقوبَتِكَ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْكَ، لاَ أُحْصِي ثَنَاءً عَلَيْكَ، أَنْتَ كَمَا أَثْنَيْتَ عَلَى نَفْسِكَ
উচ্চারণ : “আল্লা-হুম্মা ইন্নী আঊযুবিরিদ্বা-কা মিন সাখাত্বিকা, ওয়া বিমু‘আ‑ফা-তিকা মিন ‘উক্বুবাতিকা, ওয়া আঊযু বিকা মিনকা, লা উহ্সী সানা-আন আলাইকা, আনতা কামা আসনাইতা ‘আলা নাফসিকা”।
অর্থ : “হে আল্লাহ! আমি আপনার সন্তুষ্টির মাধ্যমে অসন্তুষ্টি থেকে, আর আপনার নিরাপত্তার মাধ্যমে আপনার শাস্তি থেকে আশ্রয় চাই। আর আমি আপনার নিকটে আপনার (পাকড়াও) থেকে আশ্রয় চাই। আমি আপনার প্রশংসা গুনতে সক্ষম নই; আপনি সেরূপই, যেরূপ প্রশংসা আপনি নিজের জন্য করেছেন”।
[মুসলিম]
৪.দো‘আঃ
سُبوحٌ، قُدُّوسٌ، رَبُّ الْمَلَائِكَةِ وَالرُّوحِ
উচ্চারণ : ‘‘সুববূহুন কুদ্দূসুন রব্বুল মালাইকাতি ওয়ার রূহ।’’
অর্থ :”(আপনি) সম্পূর্ণরূপে দোষ‑ত্রুটিমুক্ত, অত্যন্ত পবিত্র ও মহিমান্বিত; ফেরেশতাগণ ও রূহ এর রব্ব।”
[মুসলিম, আবু দাউদ]
৫.দো‘আঃ
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي كُلَّهُ: دِقَّهُ وَجِلَّهُ، وَأَوَّلَهُ وَآخِرَهُ، وَعَلاَنِيَّتَهُ وَسِرَّهُ
উচ্চারণ :“আল্লা-হুম্মাগফির লী যাম্বী কুল্লাহু; দিক্কাহু ওয়া জিল্লাহু, ওয়া আউয়ালাহু ওয়া ‘আখিরাহু, ওয়া ‘আলানিয়্যাতাহু ওয়া সিররাহু”।
অর্থ : “হে আল্লাহ! আমার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিন— তার ক্ষুদ্র অংশ, তার বড় অংশ, আগের গুনাহ, পরের গুনাহ, প্রকাশ্য ও গোপন গুনাহ।”
[মুসলিম]
৬.দো‘আঃ
اللَّهُمَّ لَكَ سَجَدْتُ وَبِكَ آمَنْتُ، وَلَكَ أَسْلَمْتُ، سَجَدَ وَجْهِيَ لِلَّذِي خَلَقَهُ، وَصَوَّرَهُ، وَشَقَّ سَمْعَهُ وَبَصَرَهُ، تَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسنُ الْخَالِقينَ
উচ্চারণ : “আল্লাহুম্মা লাকা সাজাদতু ওয়াবিকা ‘আ‑মানতু ওয়ালাকা ‘আসলামতু সাজাদা ওয়াজহিয়া লিল্লাযী খলাক্কাহু ওয়াসাও ওয়ারাহু ওয়া শাক্কা সাম‘আহু ওয়া বাসারাহু তাবারকাল্লাহু আহসানুল খ‑লিক্কীন” ।
অর্থ : “হে আল্লাহ! আমি আপনার জন্যই সিজদা করেছি, আপনার উপরই ঈমান এনেছি, আপনার কাছেই নিজেকে সঁপে দিয়েছি। আমার মুখমণ্ডল সিজদায় অবনত সেই মহান সত্তার জন্য; যিনি একে সৃষ্টি করেছেন এবং আকৃতি দিয়েছেন, আর তার কান ও চোখ বিদীর্ণ করেছেন। সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ্ অত্যন্ত বরকতময়।”
[মুসলিম]
৭.দো‘আঃ
سُبْحَانَ ذِي الْجَبَرُوتِ، وَالْمَلَكُوتِ، وَالْكِبْرِيَاءِ، وَالْعَظَمَةِ
উচ্চারণ : “সুবহানা যিল জাবারূতি ওয়াল মালাকুত ওয়াল কিবরিয়ায়ি ওয়াল ‘আজামাতি”।
অর্থ : “পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি সেই সত্তার, যিনি প্রবল প্রতাপ, বিশাল সাম্রাজ্য, বিরাট গৌরব-গরিমা এবং অতুলনীয় মহত্ত্বের অধিকারী।”
[মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি]
দুই সিজদার মধ্যবর্তী বৈঠকের দো‘আ সমূহঃ |
সিজদায় যে পরিমান সময় ব্যয় হবে বৈঠকেও প্রায় সে পরিমান সময় ব্যয় করতে হবে। বারাআ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সলাতে দাঁড়ানো বসা অবস্থা ব্যতীত রাসুল (সাঃ) এর রুকু, সিজদাহ এবং দুই‑সিজদার মধ্যবর্তী সময় ও রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানো, এগুলো প্রায় সমপরিমান ছিল।
[ সহীহ বুখারী-হা/৭৯২ দা.ফা, তা.হা/৭৫৬ আ.ফা,হা/৭৪৮ আ., সহীহ মুসলিম হা/৪৭১ দা.ফা।]
সিজদারত অবস্থায় ও দুই সিজদার মাঝে বসা অবস্থায় শান্ত হতে ও তাড়াহুড়া না করতে রাসুল (সাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন। দুই সিজদার মাঝে বৈঠকে পরিপূর্ণ শান্তভাবে না বসলে তার সলাত হবে না বলে তিনি জানিয়েছেন।দুই সিজদার মাঝে এই বৈঠকে আল্লাহর নবী (সাঃ) স্থির হয়ে বসে যেতেন এবং এতে তাঁর প্রত্যেক হাড় নিজের জায়গায় ফিরে যেত। (আবূদাঊদ, সুনান ৭৩৪ নং, বায়হাকী) তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকেও উক্তরুপে বসার আদেশ দিয়ে বলেছিলেন, “এভাবে সোজা ও স্থির হয়ে না বসলে কারো নামায সম্পূর্ণ হবে না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৫৭,হাকেম, মুস্তাদরাক)।
১.দো‘আঃ
رَبِّ اغْفِرْ لِي، رَبِّ اغْفِرْ لِي
উচ্চারণ :‘রব্বিগফির লী, রব্বিগফির লী”।
অর্থ: হে আমার রব্ব! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। হে আমার রব্ব! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।
[আবূ দাউদ ১/২৩১, নং ৮৭৪; ইবন মাজাহ্ নং ৮৯৭। আরও দেখুন, সহীহ ইবন মাজাহ, ১/১৪৮।]
২.দো‘আঃ
اَللّهُمَّ اغْفِرْلِيْ وَارْحَمْنِي وَاهْدِنِيْ وَعَافِنِيْ وَارْزُقْنِيْ
উচ্চারণ :“আল্লাহুম্মাগফিরলী ওয়ার হামনী ওয়া ‘আফিনী ওয়াহদিনী ওয়ারযুকনী”।
অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর, আমার প্রতি রহম কর, আমাকে সুস্থতা দান কর, সঠিক পথে পরিচালিত কর এবং রিযিক দান কর।
[ আবূ-দাঊদ, সুনান ৮৫০, তিরমিযী, সুনান ২৮৪, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৮৯৮নং,হাকেম, মুস্তাদরাক/কোন কোন বর্ণনায় উক্ত দুআর শুরুতে ‘আল্লাহুম্মা’র পরিবর্তে ‘রাব্বি ‘ ব্যবহার হয়েছে। -ইবনে মাজাহ্, সুনান ৮৯৮ নং]
৩.দো‘আঃ
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي، وَارْحَمْنِي، وَاهْدِنِي، وَاجْبُرْنِي، وَعَافِنِي، وَارْزُقْنِي، وَارْفَعْنِي
উচ্চারণ :“আল্লা-হুম্মাগফির লী, ওয়ারহামনী, ওয়াহদিনী, ওয়াজবুরনী, ওয়া‘আফিনি, ওয়ারযুক্বনী, ওয়ারফা‘নী”।
অর্থ:-“হে আল্লাহ! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আমার প্রতি দয়া করুন, আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন, আমার সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করে দিন, আমাকে নিরাপত্তা দান করুন, আমাকে রিযিক দান করুন এবং আমার মর্যাদা বৃদ্ধি করুন”।
[হাদীসটি নাসাঈ ব্যতীত সুনান গ্রন্থগারগণ সবাই সংকলন করেছেন। আবূ দাউদ, ১/২৩১, নং ৮৫০; তিরমিযী, নং ২৮৪, ২৮৫; ইবন মাজাহ, নং ৮৯৮। আরও দেখুন, সহীহুত তিরমিযী, ১/৯০; সহীহ ইবন মাজাহ ১/১৪৮।]
৪.দো‘আঃ
“আস্তাগফিরুল্লাহা রাব্বি ওয়া আতুবু ইলাইহি”
[মুসলিম ও তিরমিজি]
সেজদাহ্ শেষ করার পর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে পড়ার দো’আঃ |
“বিহ্বাও লিল্লাহি ওয়া কুওয়াতিহী আক্বূম ওয়া আক্বয়ু’দ”।
নামাজের মধ্যে পঠিতব্য যে দোয়াগুলো উল্লেখ করা হলো সেগুলো সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। উক্ত দোয়াগুলোর সবই আল্লাহ তায়ালার প্রশংসামূলক দোয়া। সুতরাং নামাজ আদায় করার সময় তাড়াহুড়া না করে সময় নিয়ে নামাজের বিভিন্ন স্থানে দোয়াগুলো পাঠ করবো ‑ইনশাআল্লহ।
নিবেদনে -
সৈয়দ হোসাইন উল হক
এম‑ফিল,ইসলামিক স্টাডিজ এন্ড হিস্টোরি,অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি।
মতামত দিন