নামাজ মাসআলা রমজান মাসের আমল ইবাদত ফজিলত ও মাসায়লাঃ

পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করার নিয়ম।

[জাফরী ও হানাফি মাজহাবের ফিকাহ অনুযায়ী পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করার নিয়ম।]

দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর যথারীতি পবিত্র ঈদুল ফিতর সমাগত। মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ। বছরে দু‘টি ঈদ উদযাপন করে মুমিন মুসলমান। ঈদের নামাজ বছরে দুবার পড়ার কারণে অনেকেই নামাজ পড়ার নিয়ম ভুলে যান। সে কারণেই মুমিন মুসলমানের জন্য ঈদের নামাজের নিয়ম জেনে নেয়া জরুরি।

জাফরী ফিকাহ অনুযায়ী ঈদুল ফিতরের নামাজের নিয়মঃ

ইমাম ইমাম মাহদী আল মন্তাজার (আ.)‘র উপস্থিতিতে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার নামায ওয়াজিব এবং তা জামাতে পড়তে হবে; কিন্তু আমাদের যমানায় ইমামের গাইবতকালীন সময়ে ঈদের নামাজ পড়া মুস্তাহাব একাকী এবং জামায়াত বদ্ধ ভাবে পড়া যায়। নয়টি তাকবীরের সঙ্গে ঈদুল ফিতরের দুই রাকআত মুস্তাহাব নামাজ। এই নামাজে আজান ও ইকামাত নাই। সূর্যোদয়ের অল্প পর হতে দ্বিপ্রহরের (যােহরের) পূর্ব পর্যন্ত ঈদের নামাজের সময়।

নামাজের নিয়তঃ- আযান ও আকামতের পরিবর্তে তিনবার ‘আসসালাত’ বলা হয় তারপর নিয়ত করিতে হয়- ঈদুল ফিতরের দুই রাকাত নামাজ আদায় করিতেছি সুন্নাতে কুরবাতান ইলাল্লাহ

প্রথম রাকাআতঃ- প্রথম রাকাতে মোট পাঁচটি তাকবির এবং পাঁচটি কুনুত বা দোয়া পড়তে হয়।প্রথমে ঈদুল ফিতরের দুই রাকআত নামাজের নিয়ত করে তাকবিরে তাহরিমা (আল্লাহু আকবার) বলে নামাজের জন্য দাঁড়াবেন।প্রথম রাকাতে সুরা ফাতেহা পাঠের পর অন্য যেকোনো একটি সুরা পাঠ করতে হবে(সূরা আলাক পড়া মুস্তাহাব)।দ্বিতীয় সূরা পাঠের পরপরই তাকবির দিয়ে একটি কুনুত বা দোয়া পড়তে হবে। অতঃপর পুনরায় তাকবির দিয়ে কুনুত পাঠ করা অর্থাৎ প্রত্যেক তাকবিরের মাঝখানে কুনুত পাঠ করা, এইভাবে মোট পাঁচটি তাকবির দিয়ে এবং পাঁচটি কুনুত পাঠ করে,পঞ্চম তাকবীরের পর আরেকটি তাকবীর দিয়ে রুকুতে যাওয়া, অতঃপর দুটি সিজদাহ সম্পন্ন করে উঠে পুনরায় দ্বিতীয় রাকাতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।

দ্বিতীয় রাকাতঃ- দ্বিতীয় রাকাতে মোট চারটি তাকবির এবং চারটি কুনুত বা দোয়া পড়তে হবে।সূরা ফাতেহার পাঠের পর অন্য যে কোন একটি সুরা পাঠ করতে হবে ( সূরা শামস পড়া মুস্তাহাব )।দ্বিতীয় সূরা পাঠের পরপরই তাকবীর দিয়ে একটি কুনুত বা দোয়া পড়তে হবে। অতঃপর পুনরায় তাকবীর দিয়ে কুনুত পাঠ করা অর্থাৎ প্রত্যেক তাকবিরের মাঝখানে কুনুত পাঠ করা, এইভাবে মোট চারটি তাকবির দিয়ে এবং চারটি কুনুত পাঠ করে, চতুর্থ তাকবীরের পর আরেকটি তাকবীর  দিয়ে রুকুতে যাওয়া, অতঃপর দুটি সিজদাহ সম্পন্ন করে তাশাহুদ ও সালাম পাঠ করে নামাজ শেষ করতে হবে।

খুতবাঃ- জাফরী ফিকাহ অনুযায়ী ঈদুল ফিতরের নামাজের শেষে সশব্দে (শ্রোতা-দর্শক শুনতে পায় এমনভাবে) দুইটি খুতবা আছে,যদি জামাত বদ্ধ হয়ে পড়া হয়।নামাজ একাকী পড়লে খুতবা পড়া লাগবে না।ঈদুল ফিতরের খােতবায় ফেতরার আহকাম বলা উত্তম।

কুনুতঃ- ঈদের নামাযের কুনুতে যেকোন দোয়া ও যিকিরই বলা যেতে পারে, এমনকি এক “সুবহান আল্লাহ”।যদি কেউ কুনুত বা দোয়া পড়তে না পারেন কমপক্ষে দরুদ পাঠ (আল্লাহুম্মা ছাল্লি আলা মুহাম্মদ ওয়া আলে মুহাম্মদ।) করলেও চলবে।কুনুত উচ্চ স্বরে পড়া মুস্তাহাব, কিন্তু জামাতবদ্ধ নামাযে মামুমের কুনুতের শব্দ যদি ইমাম শুনতে পায়, তাহল তা মুস্তাহাব নয়। কুনুতের মধ্যে কয়েকটি কাজ মুস্তাহাব। যেমনঃ দুই হাত মুখের সামনে রাখা, হাতের তালু আসমানের দিকে রাখা, বৃদ্ধাঙ্গুল ছাড়া অন্যান্য আঙ্গুল মিলিয়ে রাখা এবং হাতের তালুর দিকে দৃষ্টিপাত করা ইত্যাদি।

কুনুতে এই দোয়াটি পড়া মুস্তাহাবঃ-

«اَللّـهُمَّ أهْلَ الْكِبْرِيَاءِ وَالْعَظَمَةِ، وَأهْلَ الْجُودِ وَالْجَبَرُوتِ، وَأهْلَ الْعَفْوِ وَالرَّحْمَةِ، وَأهْلَ التَّقْوى وَالْمَغْفِرَةِ، أسْاَلُكَ بِحَقِّ هذَا الْيَومِ الَّذي جَعَلْتَهُ لِلْمُسْلِمينَ عيداً، وَ لُِمحَمَّد (صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ) ذُخْراً وَشَرَفاً وَمَزيْداً، أنْ تُصَلِّيَ عَلى مُحَمَّد وَآلِ مُحَمَّد، وَأنْ تُدْخِلَني في كُلِّ خَيْر أدْخَلْتَ فيهِ مُحَمَّداً وَآلَ مُحَمَّد، وَأنْ تُخْرِجَني مِنْ كُلِّ سُوء أخْرَجْتَ مِنْهُ مُحَمَّداً وَآلَ مُحَمَّد (صَلَواتُكَ عَلَيْهِ وَعَلَيْهِمْ) ، اَللّـهُمَّ إنّي أسْاَلُكَ خَيْرَ ما سَألَكَ مِنْهُ عِبادُكَ الصّالِحُونَ ، وَأعُوذُ بِكَ مِمَّا اسْتعاذَ مِنْهُ عِبادُكَ الْصّالِحُونَ» .ا

উচ্চারণঃ- “আল্লাহোম্মা আহলেল কিবরিয়ায়ে ওয়াল আজামাতে ওয়া আহলাল জুদে ওয়াল জাবারুতে ওয়া আহলাল আফওয়ে ওয়ার রাহমাতে ওয়া আহলাত তাকওয়া ওয়াল মাগফেরাতে আস-আলোকা বেহাক্কে হা’জাল ইউমেল লাজি জা-আলতাহু লেল মোসলেমিনা ঈদান ওয়ালে মোহাম্মাদেন সাল্লাল্লাহো আলায়হে ওয়া আলেহি জোখরাওঁ ওয়া কারামাতাওঁ ওয়া শারাফাওঁ ওয়া মাজিদান আনতো সাল্লিয়া আলা মোহাম্মাদেওঁ ওয়া আলে মোহাম্মাদেওঁ ওয়া আন তোদখেলানি ফি কোল্লে খায়রেন আদ খালতা ফিহে মোহাম্মাদাওঁ ওয়া আ’লা মোহাম্মাদেওঁ ওয়া আন্ তোখরে জানি মেন কোল্লে সুয়েন আখরাজতা মেনহো মোহাম্মদাওঁ ওয়া আলা মোহাম্মাদেন সালাওয়াতেকো আলায়হে ওয়া আলায়হেম আজমায়িনা, আল্লাহোম্মা ইন্নি আসআলোকা খায়রা মা সা আলাকা বেহি এবাদোকাস্ সালেহুনা ওয়া আউজোবেক মেম্মাস তা’আজা মেনহাে এবাদোকাল মোখলেসুন।”


হানাফি ফিকাহ অনুযায়ী ঈদুল ফিতরের নামাজের নিয়মঃ

হানাফি মাজহাবের ফিকাহ অনুযায়ী অতিরিক্ত ছয় তাকবীরের সঙ্গে ঈদুল ফিতরের দুই রাকআত নামাজ ওয়াজিব।এক তাকবির থেকে আরেক তাকবিরের মধ্যে তিন তাসবিহ পরিমাণ সময় বিরত থাকা।ঈদের নামাজের জন্য কোনো আজান ও ইকামত নেই। তবে জুমআর নামাজের মতোই উচ্চ আওয়াজে কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে ঈদের নামাজ আদায় করতে হয়।

নামাজের নিয়তঃ-নাওয়াইতু আন্‌ উছাল্লিয়া লিল্লাহি তা’য়ালা রাকআতাই সালাতিল ঈদিল্‌ ফিত্‌রি মা’আ সিত্তাতি তাক্‌বীরাতি ওয়াজিবুল্লাহি তা’য়ালা ইক্‌তাদাইতু বিহাযাল ইমাম মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি- আল্লাহু আকবর।

অর্থঃ-আমি কাবামুখী হয়ে আল্লাহ্‌র (সন্তুষ্টির) জন্য অতিরিক্ত ছয় তাকবীরের সঙ্গে ঈদুল ফিতরের দুই রাকআত ওয়াজিব নামাজ এই ইমামের পিছনে আদায়ের নিয়ত করলাম- আল্লাহু আকবর।

প্রথম রাকাআতঃ- প্রথম রাকাতে মোট তিনটি তাকবির দিতে হয়।প্রথমে ঈদের দুই রাকআত নামাজে নিয়ত করে তাকবিরে তাহরিমা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে হাত বাঁধা। অতঃপর মনে মনে ‘ছানা’ পড়বেন। তারপর ইমাম উচ্চেঃস্বরে ও মুক্তাদিগণ নীরবে পরপর তিনটি তাকবির বলবেন।প্রথম ও দ্বিতীয় তাকবিরে উভয় হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে তা ছেড়ে দেয়া এবং তৃতীয় তাকবির দিয়ে উভয় হাত বেধেঁ নেয়া। অতঃপর উচ্চ স্বরে সুরা ফাতেহা পাঠের পর অন্য যেকোনো একটি সুরা পাঠ করে,তারপর রুকুর তাকবির দিয়ে রুকুতে যাবেন। অতঃপর দুটি সিজদাহ সম্পন্ন করে উঠে পুনরায় দ্বিতীয় রাকাতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।

দ্বিতীয় রাকাতঃ- দ্বিতীয় রাকাতে মোট তিনটি তাকবীর দিতে হয়। যথানিয়মে ইমাম উচ্চ স্বরে সুরা ফাতেহা পাঠের পর অন্য যেকোনো একটি সুরা পাঠ করবেন। তারপর রুকুতে যাওয়ার পূর্বে তিনটি তাকবির বলবেন এবং উভয় হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে আবার ছেড়ে দিবেন। তারপর রুকুর তাকবির দিয়ে রুকুতে যাবেন। অতঃপর যথানিয়মে দুটি সিজদাহ সম্পন্ন করে তাশাহহুদ, দরূদ, দোয়া মাসুরা পড়ে সালাম ফেরানোর মাধ্যমে নামাজ সম্পন্ন করবেন।

খুতবাঃ-হানাফি ফিকাহ অনুযায়ী ঈদুল ফিতরের নামাজের শেষে সশব্দে (শ্রোতা-দর্শক শুনতে পায় এমনভাবে) দুইটি খুতবা আছে।নামাজ শেষে সবাই ইমামের খুতবা শুনবেন। খুতবা দেয়া প্রসঙ্গেও মতপার্থক্য রয়েছে। হানাফি মাজহাবের অনুযায়ী ঈদ ও জুমার খুতবা ওয়াজিব, অন্যান্য খুতবা সুন্নত।

ছানাঃ- ‘সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়া তাবারাকাসমুকা ওয়াতাআলা যাদ্দুকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা।


মুস্তাহাব সমূহঃ-

  • ঈদুল ফিতরে ফজরের নামাজের পর খেজুর বা মিষ্টি জাতীয় কোন কিছু খাওয়া, গোসল করা, নতুন পোশাক এবং গায়ের সুগন্ধ জাতীয় কোন কিছু লাগানো। 
  • ঈদুল ফিতরের নামাযের আগে খাওয়া ও ফিতরা দেয়া মুস্তাহাব।
  • ঈদের নামায খোলা আকাশের নিচে জামাত বদ্ধ ভাবে মাঠে পড়া মুস্তাহাব, কিন্তু মক্কাতে মসজিদুল হারামে পড়া মুস্তাহাব।
  • ঈদের নামাযে ভূমিতে সেজদা দেয়া, তাকবীর বলার সময় হাত উঠান, জামাতে হলে ইমাম এবং একাকি হলে নিজেই হামদ ও সূরা উচ্চস্বরে পড়া ইত্যাদি মুস্তাহাব।ঈদের নামাযের জামাতেও অন্যান্য জামাতের আহকাম প্রযােজ্য হবে। যেমন : সূরা-কেরাত ছাড়া অন্য সবকিছু মামুম নিজেও পড়বে।
  • ঈদুল ফিতরের আগের রাতে ওয়াজিব নামাজের পর এবং ফজর ও ঈদের নামাযের পর নিম্নলিখিত দোয়া পড়া মুস্তাহাবঃ
    الله اكبر الله اكبر لا اله الا الله و الله اکبر، الله اكبر و لله الحمد ، الله اكبر على ما هدانا»

    “আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু,ওয়া আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ,আল্লাহু আকবার,আলা মা হাদানা।”

  • মােমিনদের সহিত আলিঙ্গন ও মােসাফেহা করা।
  • ঈদের নামাযে যদি ভুলের কারণে একটি সেজদা দেয়া না হয়, তাহলে তা পরে আদায় করতে হবে; এবং সাহু সেজদার কারণ ঘটলে তা দিতে হবে।

উল্লেখ্য, অতিরিক্ত তাকবিরের সংখ্যা উভয় মতই বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এটি নিয়ে মতপার্থক্যের কোনো কারণ নেই।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যথাযথ নিয়মে ঈদের নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। ঈদের নামাজ আদায়ে যথাযথ নিরাপত্তা বজায় রেখে সুস্থ থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

নিবেদনে -সৈয়দ হোসাইন উল হক
এম‑ফিল,ইসলামিক স্টাডিজ এন্ড হিস্টোরি,অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি।


সিপাহসালার ইনস্টিটিউশন | এপ্রিল ২০২০এস এইচ হক

1 Comment

  • Excel­lent con­tent! The way you explained the top­ic is impres­sive. For fur­ther details, I rec­om­mend this link: EXPLORE FURTHER. What do you all think?

মতামত দিন