নসবনামা প্রবন্ধ সিপাহসালার সৈয়দ নাছির উদ্দিন (রহঃ) পূর্ব ও উত্তরসূরি স্থানীয় ইতিহাস

সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের (রঃ) নসবনামা তথা বংশবৃক্ষ এবং কিছু কথা। ‑সৈয়দ আবে তাহের।

বনেদি পরিবার গুলোর নিজেদের বংশবৃক্ষ সংরক্ষণ করে রাখার ইতিহাস অতী প্রাচীনতম। তিন থেকে চার বা পাঁচ পুরুষ পরপর এসকল নসবনামা হালনাগাদ করার নিয়মের প্রচলন ছিল। ইসলাম ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে বনীহাশিম তথা সাদাত পরিবার সমুহের নসবনামা সংরক্ষণকে নবী মুহাম্মদ সঃএর আমল থেকেই অপরিসীম গুরুত্ব দেওয়া হতো। সেই ধারাবাহিকতায়ই সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন রঃএর পূর্ব ও পরবর্তী বংশ পরম্পরায় নসবনামা সংরক্ষণের প্রচলন অদ্যাবধি চলমান। সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন রঃএর অধস্থন বংশধারার মধ্যে বেশকিছু প্রাচীন পরিবারে এখনও কিছু হস্তলিখিত প্রাচীন নসবনামা সংরক্ষিত রয়েছে। এখানে উপস্থাপিত নসবনামা‘টি ফার্সি হরফে ১৭শতকের শেষার্ধে হালনাগাদ কৃত ও মশাজান সৈয়দ পরিবারে সংরক্ষিত প্রাচীন তিনটি নসবনামার একটি। উপস্থাপিত পাতার শেষের দিকে উল্যেখিত ‘কিবরিয়া’ নামটি হচ্ছে সুলতানশী হাবেলী‘র প্রতিষ্ঠাতা মহাকবি সৈয়দ সুলতানের জ্যেষ্ঠপুত্র সৈয়দ গোয়াস উদ্দীন’র ডাকনাম যিনি লস্করপুর হাবেলী থেকে এসে মশাজান গ্রাম প্রতিষ্ঠা করে নিজ হাবেলী স্থাপন করেন। উল্যেখ্য যে সেই সময়কালে লস্করপুর হাবেলী‘ই ছিল সৈয়দ সুলতান বা ত্বদীয় পুত্র সৈয়দ গোয়াসের পৈতৃক নিবাস।

যাক, নীচে নসবনামার ছবি এবং এর যতটা পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তা দিলাম, অতঃপর আমরা বিষয়টা নিয়ে একটু আলোচনা করব।  

হুয়ালগণি

নসবনামা মুয়াজ্জাম ওয়া মুকাররাম

সৈয়দ আলী কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু ইবন সৈয়দ ইমাম হোছায়েন ইবন ইমাম জয়নুল আবেদীন ইবন মুহাম্মদ বাক্বের ইবন মুহাম্মদ জাফর ইবন মুছাকাজিম ইবন আলী রজা ইবন মুহাম্মদ তকী ইবন মুহাম্মদ নকী ইবন মুহাম্মদ হাসন আসকারি ইবন ইমাম মেহদী আল মন্তাজির ইবন খাজা আবু নছরা ইবন খাজা আবুল ফজল ইবন খাজা… (এখানে কিছু হরফ অস্পষ্ট)… ইবন খাজা আবুল ফত্তা ইবন খাজা দাউদ…(এখানেও কিছু হরফ অস্পষ্ট)… ইবন খাজা হাসান আরবী মদীনা হতে মশহাদ গমন করেন এবং…(এখানে কিছু শব্দের পাঠোদ্ধার করা যায়নি)… ইবন সৈয়দ নাসিরুদ্দীন সহ মশহাদ হতে হিন্দস্থান গমন করেন এবং শাহ নাসিরুদ্দীন হিন্দুস্থান হতে…(এখানেও কিছু শব্দের পাঠোদ্ধার করা যায়নি)… জয়পুরের দিকে গমন করেন এবং সেখান থেকে…(এখানেও কিছু শব্দের পাঠোদ্ধার করা যায়নি)… গমন করে এখানেই বসবাস করতে থাকেন ইবন সৈয়দ শাহ সিরাজুদ্দীন ইবনে সৈয়দ শাহ হেশামুদ্দীনের দুই পুত্র প্রথম পুত্র সৈয়দ শাহ মুছাফির ইবন সৈয়দ শাহ খোদাবান্দা এবং খোদাবান্দাকে…(এখানেও কিছু শব্দের পাঠোদ্ধার করা যায়নি)… প্রথম শাহ মিকাঈল লস্করপুর বসবাস করতে লাগেন দ্বিতীয় শাহ ইসরায়েল…(হরফ অস্পষ্ট)… বসবাস করতে লাগেন তৃতীয় শাহ সয়েফ দাউদনগর বসবাস করতে লাগেন এবং শাহ মিকাইলকে…(এখানে কিছু শব্দের পাঠোদ্ধার করা যায়নি)…ইবন সৈয়দ মিনা এর সুলতান…(এখানেও কিছু শব্দের পাঠোদ্ধার করা যায়নি)… প্রথম শাহ… (এখানেও কিছু শব্দের পাঠোদ্ধার করা যায়নি)… কিবরিয়া লস্করপুর হতে মশাদান গমন দ্বিতীয় শাহ ইনুছ…(এখানেও কিছু হরফ অস্পষ্ট)… তৃতীয় শাহ জিকরিয়া…(তারপরের লাইনের পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি)…।

পাঠক, এবার মুল আলোচনায় আসা যাক। পেশকৃত নসবনামায় ইমাম আলী আঃকে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন রঃএর ঊর্ধ্বক্রমে অন্তত ১৯তম পূর্বপুরুষ এবং ইমাম মাহদী আঃকে অন্তত ৭ম পূর্বপুরুষ হিসাবে দেখানো হয়েছে, আর অধঃক্রমে মহাকবি সৈয়দ সুলতান তথা সৈয়দ মিনা’কে অন্তত ৬ষ্ট তম এবং তাঁর পুত্রত্রয় যথাক্রমে কিবরিয়া, ইউনুস ও জিকরিয়া’কে অন্তত ৭ম অধঃস্থন বংশপুরুষ হিসাবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু বর্তমান ও গত শতাব্দীতে সংকলিত স্থানীয় ইতিহাস গ্রন্থ সমূহে তেমনকি সিপাহসালারের বংশধর গন কর্তৃক বাংলাতে হালনাগাদ কৃত নিজনিজ পরিবারের নাসবনামা সমুহে ইমাম আলী আঃকে সৈয়দ নাসির উদ্দীনের সর্বোচ্চ ১৫তম পূর্বপুরুষ এবং ইমাম মেহেদী আঃকে সর্বোচ্চ ৫ম পূর্বপুরুষ হিসাবে দেখানো হয়েছে।

এই নসবনামার বর্ণনায় পাওয়া যায়, নাসির উদ্দীনের পিতা খাজা হাসান আরাবী রঃ প্রথমে মদীনা থেকে মাশহাদ গমন করেন, তারপরে কোনও একসময় পুত্র নাসির উদ্দীনকে সাথে নিয়ে মাশহাদ থেকে হিন্দুস্থানে চলে আসেন। তারপরে একসময় সৈয়দ নাসির উদ্দীন হিন্দুস্থান থেকে জয়পুর নামক কোন এলাকা হয়ে সম্ভবত আরও কিছু স্থান ঘুরে অবশেষে তরফে এসে স্থায়ী হয়েছেন। এদিকে কোনকোন ঐতিহাসিক বর্ণনায় পাওয়াযায় নাসির উদ্দীন আব্বাসিয় রাজন্যদের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে বা রোষানলের শিকার হয়ে মদীনা থেকে দিল্লীতে এসেছিলেন অতঃপর দিল্লী থেকে এদেশে আসেন; আবার কিছুকিছু বর্ণনায় তিনি বাগদাদ থেকে দিল্লী অতঃপর দিল্লি থেকে এদেশে আসেন। তবে নাসির উদ্দীনের পিতা হাসান আরাবী রঃ যে দিল্লীতে এসেছিলেন, এমন তথ্য এই নসবনামা ব্যতিত অন্য কোনও উৎসে বর্ণীত হয়নি।

যাহোক, এই বিভিন্নতা বা বিভ্রান্তি সমুহের একমাত্র কারন নসবনামা সমূহ যথাসময়ে হুবহু হালনাগাদ না করা এবং আদী নসবনামা গুলোকে যথাযত সংরক্ষণের ত্রুটি ও এগুলোর প্রাচীনত্ব জনিত অস্পষ্টতা তেমনকি স্থানেস্থানে কালি বিলীন হয়ে যাওয়া। বলা‘ই বাহুল্য যে এখানে উত্থাপিত নসবনামা‘টাও প্রাচীনত্বের কারনে অস্পষ্টতার একটা প্রামাণিক দৃষ্টান্ত।

এবার উপর্যুক্ত সামগ্রিক বিষয়টার উপর একটু বিশ্লেষণে আসা যাক। আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী ইমাম আলী আঃএর জন্মসন ৬০০ খৃস্টাব্দ এবং উনার ১০ম অধস্থন পুরুষ ইমাম মাহদী আঃএর জন্ম সন ৮৬৯ খৃস্টাব্দ। এই দুজনের জন্মকালের পার্থক্য ২৬৯ বছর। অর্থাৎ ইমাম আলী আঃ থেকে ইমাম মাহদী আঃ পর্যন্ত ১১ প্রজন্মের একজন থেকে অন্যজনের জন্মের গড় ব্যবধান ২৭ বছরেরও কম। হ্যা, প্রজন্ম পরম্পরার এই ব্যবধানটা সর্বমহলের সর্বসুত্রেই গ্রহণযোগ্য। এদিকে প্রায় সকল স্থানীয় বইপুস্তক ও আবযদি তথ্য অনুযায়ী সিপাহসালারের জন্মসন ১২৫০ খৃস্টাব্দ। এবং বর্তমান ও গত শতাব্দিতে রচিত প্রায় সকল বইপুস্তকের তথ্য এবং শুধুমাত্র উপস্থাপিত নসবনামা ব্যতিত হাল শতকে প্রণীত প্রায় সকল বাংলা নসবনামা অনুযায়ী আলী আঃ থেকে সৈয়দ নাসির উদ্দীন পর্যন্ত ১৫ প্রজন্মে ৬৫০ বছরের সময়কালে একজন থেকে অন্যজনের জন্মের গড় ব্যবধান ৪৩ বছরেরও বেশি, আবার ইমাম মাহদীর সাথে সিপাহসালার পর্যন্ত মাত্র ৫ প্রজন্মের কময়কাল ৩৮১ বছরে একজন থেকে অন্যজনের জন্মের গড় ব্যবধান ৭৬ বছরেরও বেশি। সুতরাং এই সকল প্রচলিত তথ্য সমুহ গবেষণা মূলক বিশ্লেষণ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস বিচারে সন্দেহযুক্ত বটে।

এদিকে এই আলোচনায় উপস্থাপিত নসবনামা‘র বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আলী আঃ থেকে নাসির উদ্দীন পর্যন্ত অন্তত ২০ পুরুষে একজনের থেকে অন্যজনের জন্মের গড় ব্যবধান সারে ৩২ বছর, আর ইমাম মাহদী আঃ থেকে সিপাসালার পর্যন্ত অন্তত ৮ পুরুষের জন্মের গড় ব্যবধান প্রায় সারে ৪৭ বছর। যদিও এই নসবনামা থেকে প্রাপ্ত ব্যবধানটাও কিছুটা হলেও অস্বাভাবিক তথাপী আমরা দুটি কারনে এটাকে অস্বাভাবিক ধরতে পারিনা। কারন গুলো হচ্ছে, পেশকৃত প্রায় মুছে যাওয়া নসবনামায় স্পষ্টভাবে প্রাপ্ত প্রজন্ম সংখ্যার চাইতে বেশি প্রজন্ম থাকারও ইঙ্গিত বিদ্ধমান রয়েছে, এবং হতেপারে ইমাম মাহদী আঃ তাঁর দ্বিতীয় গায়বতে গিয়ে বিবাহ করেছিলেন। সেক্ষেত্রে হিসাবটা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ইতিহাস ও আবযদি সুত্র অনুযায়ী উপস্থাপিত এই নসবনামা‘র সাথে বরাবরই মিলে যায়।

এখন আসাযাক আব্বাসিয় রাজন্যদের প্রতি বিতশ্রদ্ধ বা রোষানলের শিকার হয়ে আরব রাজ্য ছেড়ে সিপাহসালারের পক্ষে হিন্দুস্থানে আসা আদৌ কি সম্ভব- নাকি তাঁর পিতা হাসান আরাবী রঃ পুত্র নাসির উদ্দদীনকে সাথে নিয়ে এসেছিলেন? এর উত্তর হচ্ছে, হালাকু খাঁ’র প্রচণ্ড আক্রমনে আব্বাসিয় খেলাফত ধ্বংস হয়ে যায় ১২৫৮ সালে, আর নাসির উদ্দীনের জন্ম হয় প্রায় ১২৫০ সালে। অর্থাৎ আব্বাসিয় খেলাফত ধ্বংস হওয়ার বছরে নাসির উদ্দীনের বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর। অর্থাৎ আব্বাসিয় খেলাফতের অন্তিম লগ্নে নাসির উদ্দীন ছিলেন প্রায় দুগ্ধপুস্য শিশু। এই অবুঝ শিশু সন্তানের পক্ষে কোনভাবেই রাজন্যদের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হওয়া বা পিতামাতা ছাড়া একা সুদুর আরব থেকে দিল্লীতে চলে এসে একা জীবন ধারণ করার ধারনাটা অযৌক্তিক বলাটা মোটেই অযৌক্তিক নয়। সুতরাং এই নসবনামায় বর্ণীত তথ্যটাই নির্ভরযোগ্য যে কিশোর নাসির উদ্দীন তাঁর পিতা হাসান আরাবী’র হাত ধরেই হিন্দুস্থানে এসেছিলেন। 

লেখার শেষভাগে এসে চিন্তাশীল পাঠকদের প্রায়ই করা একটা প্রশ্নের সমাধান দেব। ইন্টারনেটে মশাজান সৈয়দ বংশের নসবনামা দেখে অনেকেই জিজ্ঞেস করেন- সিপাহসালারের উর্ধক্রমের বেশ কয়েকজনের নামের আগে “খাজা” লেখা কেন? হ্যা পাঠক, ইমাম মাহদী’র পর থেকে এই বংশধারায় হাসান আরাবী পর্যন্ত “খাজা” লকব লাগিয়ে ছদ্মবেশ ধারনের কারন এটাই হতেপারে যে তারা ছিলেন গায়েবে থাকা ইমামের আহলে বাইত তথা সন্তানসন্ততি, একারনেই হয়তো তাঁদের আসল পরিচয়টা খুব সতর্কতার সহিত গোপন রাখা অত্যাবশ্যক ছিল; পরে যখন আব্বাসিয় সাম্রাজ্য ছেড়ে হিন্দুস্থান চলে আসেন অতঃপর আব্বাসিয়দেরও পতন হয়ে গেছে, তখন থেকে আর এতটা গোপনীয়তার প্রয়োজন থাকেনি; ফলে সাত/আট পুরুষব্যাপী ধারণকৃত ছদ্মবেশী লকবটা ঝেড়ে ফেলে নাসির উদ্দীনের আমল থেকে আবার নামের সাথে “সৈয়দ” লকবটা যুক্ত হয়। 

About the author

Sipahsalar

মন্তব্য

মতামত দিন