মসাজানের দিঘী
সৈয়দ হোসাইন উল হক
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভুমি সিলেটের হবিগঞ্জ দেশী বিদেশী পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি স্থান। সুনীল আকাশ, ঘাঢ় সবুজ পাহাড়, এ যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোন ছবি। আপনাদের জ্ঞাতার্থে খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে আমার ছোট্ট এ প্রয়াস। বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ১০ নং লস্করপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত“মসাজান” একটি ঐতিহাসিক গ্রামের নাম। সৈয়দ মিনা উরফে সৈয়দ সুলতান (রঃ) সহোদর ভাই এককালের তরপের অধিপতি,আরাকান রাজ্যের রাজ দরবারী সৈয়দ মুসা’র নাম থেকে ‘মুছাজান’ যা বর্তমানে মসাজান (مسجن) নামকরন হয়েছে।
সৈয়দ মিনা উরফে সৈয়দ সুলতান(রঃ) ও সৈয়দ মুসা (রঃ) সিলেটের তরফ অঞ্চলের লস্করপুর নিবাসী সৈয়দ শাহ মিকাঈল (রহঃ) এর পুত্র ছিলেন। সৈয়দ মিনা উরফে সৈয়দ সুলতান(রঃ) লস্করপুর হতে হবিগঞ্জ উপজেলার সুলতানসী গিয়ে বসতি স্থাপন করেন।সৈয়দ মিনা উরফে সৈয়দ সুলতান(রঃ) ‑এর নামানুসারে “সুলতাসী” নামকরন হয়। সৈয়দ মিনা উরফে সৈয়দ সুলতান(রঃ) এর ৩ জন পুত্র সন্তান ছিলেন।
১ ) সৈয়দ শাহ গোয়াস (রঃ)ওরফে কিবরিয়া [মসাজান আদি]
২ ) সৈয়দ শাহ ইউনুছ (রঃ)[সুলতানসী হাবেলী]
৩ ) সৈয়দ শাহ জিকরিয়া(রঃ)[সুলতানসী হাবেলী]
সাধক ও সমাজ সংস্কারক সৈয়দ শাহ গোয়াস (রঃ)ওরফে কিবরিয়া ছিলেন তাঁর চাচা সৈয়দ মুসার প্রিয়পাত্র। তিনি তাঁর সহোদর দু’ভাইকে মূল বাড়ী সুলতানসী (সাত আনী অংশ) হাবিলীতে রেখে সুলতানসী হতে ২ কিলোমিটার পশ্চিমে শ্রদ্ধেয় চাচা সৈয়দ মুসা (রঃ) নামে প্রতিষ্ঠিত “মসাজান” এ বসতি স্থাপন করেন।হবিগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৫ কি.মি. দূরত্বে মশাজান গ্রামের অবস্থান। পাকা সড়ক থেকে গ্রামের সড়কে প্রবেশের মুখে আপনাকে স্বাগত জানাবে একটি তোরণ। তারপর গাছপালার ছায়ার মধ্যে দিয়ে মিনিট পাঁচেকের পর আপনাকে থমকে দাঁড়াতে হবে। কারণ আপনার সামনে তখন নীলচে সবুজের বিশাল জলরাশি স্থানীয়ভাবে যার নাম মশাজান দীঘি বা সৈয়দ গোয়াসের দীঘি বলা হয়।চারদিকে সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত দীঘিটি সত্যিই অপূর্ব। দীঘির ঝলমল পানি, ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ, শাপলা শালুকের উপস্থিতি আরও মনোমুগ্ধকর করে তোলে। আস্তে আস্তে যতই সামনের দিকে এগুতে থাকবেন ততই ভাল লাগবে।স্থির, স্বচ্ছ এই জলরাশি দেখলেই ইচ্ছে জাগবে ছুঁয়ে দেখতে।অনেকে আবার আগ্রহী হতে পারেন এই দীঘির ইতিহাস জানতে।
ষোল’শ শতকের প্রথম দিকে দুইশত একর সীমানার মধ্যভাগে অবস্থিত এ দীঘির প্রতিষ্ঠাতা আধ্যাত্নিকপুরুষ খ্যাত সৈয়দ গোয়াস (রঃ) ছিলেন মধ্য যোগীয় মহাকবি সৈয়দ সুলতানের জ্যেষ্ঠসন্তান এবং সিলেট ও তরফ বিজয়ী সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (রঃ)‘র ষষ্ঠ অধস্থনপুরুষ।সৈয়দ শাহ গোয়াস (রঃ)ওরফে কিবরিয়া একজন কামেল ওলী ছিলেন। তিনি আরবী, ফার্সী, উর্দু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।
আবহমান কাল থেকে প্রচলিত লোকশ্রুতি বা স্থানীয়দের লালিত কিংবদন্তী যে, অত্র বিজন স্থানে একটি সুপেয় জলাশয়ের জন্য আল্লাহ্র কাছে তাঁর প্রিয় অলী সৈয়দ গোয়াস (রঃ)‘র মদদ প্রার্থনার প্রেক্ষিতে আকাশ আলোকিত করে নেমে আসা ফেরেশতাদের দ্বারা এক রাত্রিতে প্রায় দেড়’শ বিঘা জমির উপর দীঘি খনন করেন, যা আজও সকলের নিকট একারনেই সৃষ্টির পর থেকে কখনও এ দিঘিকে সংস্কার কিংবা পুনঃখননের প্রয়োজন হয়নি, কালক্রমে নিজে থেকেই এটা গভীরতা প্রাপ্ত হয়। সমাদৃত। এই দিঘির বয়স নাকি প্রায় তিনশ বছর। দৃষ্টিনন্দন ও সুবিশাল এ দীঘিটি বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থান হিসাবে স্বীকৃত।
আরো জানা যাবে, দীঘির অলৌকিকত্ব সম্পর্কে।চারপাশে ঘন গাছগাছালি পরিবেষ্টিত লম্বাটে চৌকোণা আকৃতির দিঘীটির তলভাগে কোন রহস্যজনক কারনে অসংখ্য ছোটবড় নিকষকাল রঙের অমসৃণ শিলাখণ্ড বিদ্ধমান। দৃশ্যত(পরীক্ষিত নয়)এই পাথরগুলো উল্কাপিণ্ডের সাথে হুবহু সামঞ্জস্যপূর্ণ। হয়তো এই পাথরগুলোর প্রভাবেই এর পানি কাঁচের ন্যায় এতটাই স্বচ্ছ যে অনেক গভীরের তলদেশ পর্যন্ত স্পষ্টত দেখা যায়। এই দিঘীর পানিতে বিভিন্ন রকম মাছ থাকা স্বত্বেও আশ্চর্যজনক ভাবে লক্ষ্যনিয় বিষয় যে এতে কোনও ধরনের কচুরিপানা, জলযদ্ভিদ, সাধারণ কীটপতঙ্গ একেবারেই টিকে থাকতে পারেনা। এমনকি গ্রামের জলাশয়ে যে প্রাণীটির অবাধ বিচরণ থাকে সেই জোঁক‑ব্যাঙ থেকেও দীঘিটি মুক্ত।
তাছারাও স্থানীয় জনগণের পরীক্ষিত বিষয় হিসেবে এটাও স্বীকৃত যে এই দিঘীতে কয়েকবার গোসল করলে সধারন পাছড়া বা চর্মরোগ সেরে যায়। সুপেয় পানি রোগ নিরাময়ের জন্য দূর‑দূরান্ত থেকে বিশ্বাসীরা আসেন সংগ্রহ করতে।কিন্তু এসবের কারন নিরূপণে স্মরণকাল যাবত “অলির কেরামত” বলে প্রচলিত একটা লোকশ্রুতি ।চারপাশের ১২০টি পরিবার এই দীঘি ব্যবহার করেন। সাধারণত দেখা যায়, গ্রামে এ ধরণের জলাশয়ের দখল বা ব্যবহার নিয়ে প্রায়ই দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি হয়। কিন্তু আপনাকে জানানো হবে এ যাবৎকাল পর্যন্ত এই দীঘি নিয়ে ব্যবহারকারীদের মধ্যে কোন সমস্যা হয়নি।
সৈয়দ শাহ গোয়াস (রঃ) ওরফে কিবরিয়া-এর বংশধর গনই মসাজান‑এ আছেন। প্রচীরঘেরা দীঘির পশ্চিম‑দক্ষিণকোনে হোসাইনী মোকামের পার্শ্বে আল্লাহর এই ওলী শুয়ে আছেন। আজও দিক‑দিগন্ত হতে হাজার হাজার মানুষ আল্লাহর এই ওলীর কৃতী পরিদর্শনে ছুটে আসেন। সময় সুযোগ করে আল্লাহর ওলী সৈয়দ গিয়াস উদ্দিন ওরেফ সৈয়দ গোয়াস (রঃ) এর মাজার যিয়ারত সহ তাঁর অলৌকিক কৃতী, প্রকৃতি এই বিশাল সৌন্দর্য মসাজান দিঘী পরিদর্শন করতে পারেন।
তথ্য সুত্র:
- গবেষণা গ্রন্থঃ গবেষণার আলোকে তরফ বিজয়। লেখকঃ সৈয়দ আব্দুল্লাহ, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক,গবেষক, লেখক।
- গবেষণা প্রবন্ধঃ মরমী সাহিত্য ও সূফী সাধনা। লেখকঃ সৈয়দ হাসান ইমাম হুসেনী। লেখক, গবেষক, সমাজ সংস্কারক। প্রকাসঃ ১৯৮৪ ইং।
- গবেষণা প্রবন্ধঃ তরফ বিজয়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। লেখকঃ সৈয়দ আব্দুল্লাহ,ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক,গবেষক, লেখক। প্রকাসঃ ১৯৯৪ সন।
- গবেষণামূলক সম্মেলিত প্রকাসনাঃ হবিগঞ্জ পরিক্রমা। প্রকাসঃ ১৯৯৪ সন।
- স্থানীয় ঐতিহ্যমুলক পুস্তকঃ মসাজান দর্পণ। প্রকাসকঃ সৈয়দ মকলিছ মিয়া, সৈয়দ আব্দুন নবী ও সৈয়দ আব্দুল বারী জেলা প্রশাসক। প্রকাসঃ ১৯৮০ সন।
- গবেষণামুলক গ্রন্থঃ হযরত শাহজালাল রঃ ও তাঁর কারামত। লেখকঃ সৈয়দ মোস্তফা কামাল। প্রকাসঃ ১৯৮৪ সন।
মতামত দিন