প্রবন্ধ

বিশ্ব নারী দিবস।

নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছ তবু
হাসি দিয়ে বরণ করেছ আমাদের,
তুমি সর্বেসর্বা, তুমি মমতার প্রতিচ্ছবি হে নারী!
তোমায় হাজার সালাম!
স্বরচিত ২লাইন লিখে দিলাম, শুধু আপনাদের উদ্দেশ্যে। নারীর তিনটি রুপ। কন্যা, স্ত্রী এবং মা। আর তিনটি রুপই আল্লাহর রহমত। কন্যা তার পিতার জন্য রহমত। স্ত্রী তার স্বামীর ইমানের সাক্ষ্যদাত্রী এবং মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। যার জন্য উৎসর্গ করা যায় বছরের প্রত্যেকটি দিন। তাকে উদ্দেশ্য করে যা-ই করা হয়, তা-ই হয়তো তার করা কাজের কাছে কম। তাই তার উদ্দেশ্য করে আর তাকে সম্মান জানাতে বিশ্বে একটি দিন পালিত হয় নারী দিবস হিসেবে।আপনারা যেভাবে চিন্তা করতে পারেন, পরিস্থিতি সামলাতে পারেন, ভালবাসতে পারেন- তার সিকিভাগও আমরা পারি না, কোনদিন পারবোও না। সত্যিই আপনারা না থাকলে পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর সৃষ্টি দেখতে পেতাম না।
আজ বিশ্ব নারী দিবস। আজকের এই দিনে পৃথিবীর সকল সম্মানিত নারী সমাজকে জানাই অসীম শ্রদ্ধা, অশেষ কৃতজ্ঞতা ও নারী দিবসের শুভেচ্ছা।
নারী’র প্রথম অক্ষরটিই ‘না’। তাই হয়তো একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসেও নারীকে শুনতে হয় ‘না’। মানবচক্রের যেই মাধ্যমে আমাদের এই পৃথিবীতে আসা, তার একটি অপার মাধ্যম এই নারী। এই নারী কখনো আপনার মা, কখনো আপনার বোন আবার কখনো স্ত্রী। ধর্মেও আছে নারীর সম্মানের স্থান। হাজার সম্পর্কের মাঝে তাদের সঙ্গে আপনার আমার সম্পর্ক অন্যতম। নিজেকে অন্যের সুখে হাসতে হাসতে বিলিয়ে দিতে পিছপা হন না এই নারী। তাই হয়তো একাই ভালোবাসে সমস্যা ও সমাধানের হালটি কাঁধে তুলে নিতে। নানা ঘাত‑প্রতিঘাত পার করেই চলে এই নারীর জীবন।
একবার ভেবে দেখুন তো, নারী ছাড়া পৃথিবীটা কেমন হত ? হ্যাঁ, ভাবুন। একটু থামুন, থামুন। ভাববেন কিভাবে ? নারী ছাড়া আপনার অস্তিত্বইতো কাল্পনিক। অর্থাৎ নারী ছাড়াতো পৃথিবীতেই আসার উপায় নেই, ভাবনা চিন্তাতো দূরের কথা। নারী, পৃথিবীর অর্ধেক একটা শব্দ। নারীকে বাদ দিয়ে কোন কিছু ভাবনা চিন্তা করা যায় না। শিশুকাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা কোন না কোন ভাবে নারীর অদৃশ্য বাঁধনে জড়িয়ে আছি। পুরুষ আর নারীর সমষ্টিগত নাম মানুষ। মানবকুল নারী-পুরুষ দ্বারা গঠিত। নারী থেকে পুরুষ, পুরুষ থেকে নারী কোনভাবেই আলাদা করার সুযোগ নেই। এই পৃথিবীতে মানব সমাজের অস্তিত্ব থাকতে হলে নারী-পুরুষের যৌথ উপস্থিতি অপরিহার্য। নারীর কাছে পুরুষ, আর পুরুষের কাছে নারী ঋণী। এই দুই এর কোন একজনকে বাদ দিয়ে মানব জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না।একদিকে যেমন একজনকে ছাড়া আরেকজনের অস্তিত্বই বিপন্ন, অন্যদিকে একজনের কাছে আরেকজন অপরিহার্যভাবে ঋণী। সুতরাং ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, সব জীবনেই একজনের কাছে আরেকজন দায়বদ্ধ।
নারী এক মূল্যবান রতন। কিন্তু আমরা পুরুষ সমাজ কতটা মূল্য দেই তাদের । তারা কি তাদের সঠিক মূল্য পায়। নারী নিয়ে দু’একটা কথা বললে একজন পুরুষ নারীবাদী হয়ে যায় না বরং একজন সুপুরুষ হিসাবে আমাদের কর্তব্য নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।শুধু ভাত, মাছ, শাড়ি কাপড়ই দেওয়াই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা নয়, নারীদের সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতা প্রদান, নারীর মতামত গ্রহন, মতামতের মূল্যায়ন, নারীর কাজে সহায়তা করারা সমন্বয়ে গঠিত হওয়া চাই নারীর অধিকার।
▪️আব্রাহাম লিঙ্কনের মতে যেমনঃ– ‘কোন পুরুষের সহায়তা ছাড়া কোন নারী বিপদে যায় না’ তেমনি আমার মতে – ‘পুরুষের সহায়তাই পারে নারীকে তার অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করতে।
নারী ও পুরুষ হচ্ছে কালি ও কলমের মতো, একটি ছাড়া অন্যটি অচল ।তবে , নারী অধিকারের নামে পুরুষালী আচরন করা কোন নারীর সুন্দর রূপ হতে পারে না। কেননা, পুরুষেরা বুদ্ধিমতি নারী পচ্ছন্দ করে কিন্তু পুরুষালি নারী নয়। নারীর কোমলতা, মায়া, ভালোবাসা, শ্রদ্ধার সমন্বয়েই নারীর অধিকারের বহির্প্রকাশ ঘটানো উচিত। উগ্রতা, অসভ্যতা, নোংরামী, প্রাগল্‌ভ্যতা, প্রাচ্য সংস্কৃতির অনুকরণ কখনো নারীর অধিকারের সুষ্ঠ বিষয় হতে পারে না।
▪️কুইন ক্রিষ্টিনা বলেছেন –
“পুরুষ মানুষ বলেই আমি পুরুষদের ভালোবাসি, তা নয়।এই জন্যই ভালোবাসি যে তারা মেয়ে মানুষ নয়।”
বড় অদ্ভুত রহস্যময়ী এ নারী চরিত্র। তবুও, সকল নারীকেই ভালোবাসতে শিখলে নারীরাও তাদের ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে ।তাই, নারী অধিকার রক্ষায় নারী এবং পুরুষ উভয়কেই একত্রে এগিয়ে আসতে হবে। নারীদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে, ‘কোন নারীর অধিকার রক্ষা মানে শুধু সেই নারীকে অনাধিকার থেকে রক্ষা করাই নয় বরং নারী জাতিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া’। পুরুষদের ক্ষেত্রে এটা লক্ষ্য রাখা উচিত যে, ‘কোন নারীর অধিকার রক্ষা করা মানে কোন নারীর প্রতি দুর্বলতা প্রদর্শন নয় বরং নিজেকে প্রকৃত পুরুষ হিসাবে নারীর সামনে তুলে ধরা’।
মহাবিজ্ঞানময় আল্লাহ পাক জগতের প্রাণীকূলকে দুই জাতিতে বিভক্ত করে সৃষ্টি করেছেন। নর ও নারী। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাজে রহস্য আছে। হিকমত বা রহস্য ছাড়া তিনি কোন কাজ করেন না। মানুষসহ প্রাণীকূলকে নর এবং নারী দুই জাতিতে বিভক্ত করে সৃষ্টি করেছেন। উভয়কে যৌবন দান করেছেন। একের প্রতি অন্যের আকৃষ্ট হওয়ার অনুভূতি দিয়েছেন, যৌবনের অনুভূতি উন্মাদনা দান করে সন্তান জন্ম দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। যাতে করে প্রাণীকূল দুনিয়াতে ভবিষ্যত প্রজন্ম রেখে যেতে পারে।
আদি পিতা হযরত আদম আ. কে মহান রাব্বুল আলামীন নিজ কুদরতি হাতে সৃষ্টি করেছেন। তারপর সৃষ্টি করেছেন মা হাওয়া আ. কে। সৃষ্টিগতভাবে আদম ও হাওয়া আ. এক ও অভিন্ন মর্যাদার অধিকারী। পবিত্র কোরআনে কারীমে মহান আল্লাহ তা‘আলা নর ও নারী উভয়কে সম্বোধন করে কথা বলেছেন। সুতরাং ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়ের ধর্ম। এখানে এমন প্রশ্ন করার অবকাশ নেই যে, ইসলাম কি পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম না নারীবাদী ধর্ম? উভয়ের ধর্মই ইসলাম; মানবতার ধর্ম ইসলাম।
বর্তমানে পৃথিবীতে কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবি আছে, যারা নিজেদেরকে নারীবাদী বলে পরিচয় দেয়। আর নারীবাদের বিপরীতে তারা পুুরুষতন্ত্র নামে একটি পরিভাষা আবিষ্কার করেছে। লজ্জার ব্যাপার হল এই নারীবাদীরা পুরুষ হয়ে নিজেদের নাম দিয়েছে নারীবাদী। তারা পৃথিবীর মানুষকে দু’ভাগে বিভক্ত করতে চায়‑পুরুষবাদী ও নারীবাদী। এরই প্রেক্ষাপটে বহু লেখক‑লেখিকা ইসলামকে নারী বিদ্বেষী ধর্ম হিসেবে চিত্রায়িত করতে চায়। তাদের ধারণা, ইসলাম হল পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম। এ ব্যাপারে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন একধাপ এগিয়ে আছে। বছরের চাকা ঘুরে যখন ৮ই মার্চ ‘নারী দিবস’ আসে তখন এই কথাগুলো বিশেষভাবে উচ্চারিত হয়। মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়।
নারীবাদীদের বক্তব্য হল- নারীরা অধিকার থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে ইসলাম নারীদের অধিকার খর্ব করেছে। নারীর অগ্রযাত্রায় অনেক বাধা দিয়েছে, সৃষ্টি করেছে নানা প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু নারীবাদীদের ফর্মুলায় আধুনিক যুগে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হয়নি। এসব কারণে ২০০৯ইং সনের নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘‘নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে দরকার নারী পুরুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা”।
মূলত এসব বুদ্ধিজীবীরা নারীর সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থানের ভুল ও বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা দিয়ে নারীকে করে প্রতারিত, অপমানিত; সমাজকে করে কলুষিত। তাই নারীবাদীদের ষড়যন্ত্রের খপ্পর থেকে নিরীহ নারী জাতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে নারীদের সঠিক সামাজিক অবস্থান নির্ণয় করা অপরিহার্য।
পৃথিবীর ইতিহাসে ‘আইয়্যামে জাহিলিয়াত’ নামে একটা যুগ ছিল। অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ। তখন মানুষ তার চারিত্রিক অবক্ষয় দ্বারা গোটা পৃথিবীকে ঘোর অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছিল। পৃথিবী, মানুষ, নারী-পুরুষ সবই ছিল। ছিল না সত্যের আলো। সততা, সাম্য, মর্যাদা, অধিকারকে ঢেকে রাখা হয়েছিল অসৎ চরিত্রের কালিমা লেপনের মাধ্যমে। সেই অন্ধকার যুগে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল নারীসমাজ। নারীসমাজ কোন বিধানের আওতায় ছিল না। ফলে নারী হয়ে উঠেছিল পুরুষের উপভোগের সামগ্রী মাত্র। ঠিক তখনই সারা পৃথিবীর মানবতার দিশারি ও শান্তির দূত, যার একক জ্ঞান পৃথিবীর আদি-অন্ত সকল মানুষের জ্ঞানের উর্ধ্বে, সেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সা.-কে দুর্যোগপূর্ণ সময়ে আলোর বার্তা, মানবজাতির জাতীয় সংবিধান পবিত্র কুরআনুল কারীম দিয়ে মহান আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর বুকে প্রেরণ করেন। তখন অন্ধকারে আচ্ছাদিত পৃথিবীর মানুষকে তিনি ফিরিয়ে আনলেন আলোর ভূবনে। মানবতা পুনরায় মুক্তি পেল। মানুষ পেল তার ন্যায্য অধিকার,আল্লাহ ও তদীয় রাসুল সা. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হল নারীর অধিকার ও মর্যাদা। বিশ্বনবীর কল্যাণে মহিয়সী নারী মর্যাদা পেয়েছে মাতা হিসেবে। পিতা-মাতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বামীর সংসারে স্ত্রীর অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। নারী তার বৈবাহিক জীবনে খাদ্য উপার্জনের চিন্তা হতে মুক্ত হয়েছে। তেমনিভাবে সমাজের সসর্বস্তরের নারীর যথার্থ মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলাম সর্বক্ষেত্রে নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান ও যথাযথ অধিকার দিয়েছে। নারীর মর্যাদা বলতে কী বুঝায়? মর্যাদা মানে পদ ও সম্মান। কারও পদ বা মর্যাদার অর্থ হচ্ছে যথাযথভাবে তার প্রাপ্য প্রদান করা। আর প্রাপ্য বলতে তাদের অধিকার স্বীকার করা, কর্তব্যের যথাযথ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও সামাজিক জীবনে তার অবদানসমুহের মুল্যায়নকে বুঝায়। নারীর মর্যাদা দেওয়ার অর্থ হচ্ছে তার ন্যায্য অধিকার সঠিকভাবে আদায় করা, তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের সঠিক ব্যাখ্যা ও তার অবদানের যথাযথ মুল্যায়ন করা। ইসলাম মানব প্রকৃতির সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি জীবন বিধান। এখানে মানুষকে সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। নারী-পুরুষ সবাই মানুষ হিসেবে এই মর্যাদার অংশীদার। মানবকুল নারী-পুরুষ দ্বারা গঠিত। নারী থেকে পুরুষ, পুরুষ থেকে নারী কোনভাবেই আলাদা করার সুযোগ নেই। এই পৃথিবীতে মানব সমাজের অস্তিত্ব থাকতে হলে নারী-পুরুষের যৌথ উপস্থিতি অপরিহার্য। নারীর কাছে পুরুষ, আর পুরুষের কাছে নারী ঋণী। এই দুই এর কোন একজনকে বাদ দিয়ে মানব জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। একদিকে যেমন একজনকে ছাড়া আরেকজনের অস্তিত্বই বিপন্ন, অন্যদিকে একজনের কাছে আরেকজন অপরিহার্যভাবে ঋণী। সুতরাং ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, সব জীবনেই একজনের কাছে আরেকজন দায়বদ্ধ।
মানুষ সামাজিক জীব, অন্যদিকে প্রকৃতির অংশ। তাই মানুষকে জীবন ধারণ, বেঁচে থাকা ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রাকৃতিক ও সামাজিক উভয় বিধানই মেনে চলতে হবে। প্রাকৃতিক বিধান লঙ্ঘন করলে ধ্বংস অনিবার্য। আর সামাজিক বিধান ভঙ্গ করলে নেমে আসে বিপর্যয়। সামাজিক নিয়মগুলো প্রকৃতি থেকে মানুষের লব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে গড়ে ওঠে। বিধানসমূহের মধ্যে ধর্মীয় বিধানই শ্রেয়।
ইসলামের মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ‘নিসা’ অর্থাৎ ‘মহিলা’ শব্দটি ৫৭ বার এবং ‘ইমরাআহ’ অর্থাৎ ‘নারী’ শব্দটির ২৬ বার উল্লেখ হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ‘নিসা’ তথা ‘মহিলা’ শিরোনামে নারীর অধিকার ও কর্তব্যসংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র বৃহৎ সূরাও রয়েছে। এ ছাড়া কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসে নারীর অধিকার, মর্যাদা ও তাদের মূল্যায়ন সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। ইসলাম নারীর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। দিয়েছে নারীর জান‑মালের নিরাপত্তা ও সর্বোচ্চ সম্মান।
▪️নারীর শিক্ষাঃ
নারীদের তালিম তালবিয়ার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আছে, ‘তোমরা তাদের (নারীদের) সঙ্গে উত্তম আচরণ করো ও উত্তম আচরণ করার শিক্ষা দাও।’ (সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ১৯)। মহানবী (সা.) ঘোষণা করেন, ‘যার রয়েছে কন্যাসন্তান, সে যদি তাকে (শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে) অবজ্ঞা ও অবহেলা না করে এবং পুত্রসন্তানকে তার ওপর প্রাধান্য না দেয়; আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা নারীদের উত্তম উপদেশ দাও (উত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করো)।’ হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘ইলম শিক্ষা করা (জ্ঞানার্জন করা) প্রত্যেক মুসলিম নর‑নারীর প্রতি ফরজ (কর্তব্য)।’ (উম্মুস সহিহাঈন-ইবনে মাজাহ শরিফ)।
নারীর মর্যাদা ইজ্জত সতীত্ব সুরক্ষার জন্য আল্লাহতায়ালা পর্দার বিধান ফরজ করেছেন। কুরআনে এরশাদ হয়েছে, হে নবী! মুমিনদেরকে বলে দিন, তারা যেন পরস্ত্রী থেকে তাদের দৃষ্টি অবনমিত রাখে এবং নিজ যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। তেমনি মুমিন নারীদেরকে বলে দিন, পুরুষের থেকে তাদের দৃষ্টি অবনমিত রাখে এবং স্বীয় যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষা করে। (সুরা নুর: ৩০) নারীরা পুরুষ থেকে পর্দা করবে। তার রূপ‑সৌন্দর্য পরপুরুষ থেকে আবৃত রাখবে। পর্দার অর্থ এই নয় যে, নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখা বরং প্রয়োজনে পর্দার সঙ্গে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে ইসলাম। পর্দার মাধ্যমে খাঁচার পাখির মত বন্দি করে রাখা নয় বরং নারীর ইজ্জত ও সম্মান রক্ষার জন্য ইসলামের এ বিধান। মুসলিম সমাজে সভ্যতায় মেয়ে অপেক্ষা ছেলের দায়দায়ত্বত্ব বেশি। নারী ও পুরুষ কার অধিকার বেশি? কার মর্যাদা বেশি? সামগ্রিক বিচার‑বিশ্লেষণ শেষে জবাব হবে- নারী-পুরুষের অধিকার ও মর্যাদা কোনো ক্ষেত্রে সমান, আবার কোনো ক্ষেত্রে কমবেশি। ইসলাম ঢালাওভাবে সবাইকে সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার দেয়নি।
▪️নারীর আধ্যাত্মিক শিক্ষাঃ
একইভাবে আধ্যাত্মিক মহিমা অর্জনের ক্ষেত্রেও নারীর কর্তব্য রয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এ কথা সুনিশ্চিত, যে পুরুষ ও নারী মুসলিম মুমিন, হুকুমের অনুগত, সত্যবাদী, সবরকা, আল্লাহর সামনে বিনত, সাদকা দানকারী, রোজা পালনকারী, নিজেদের সম্ভ্রমের হেফাজতকারী এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণকারী, আল্লাহ তাদের জন্য মাগফিরাত ও প্রতিদানের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।’ (সূরা-২২ আহজাব, আয়াত: ৩৫)।
▪️মা হিসেবে নারীর সম্মানঃ
মা চাঁদের আলোরমত আর বাবা সূর্যের আলোরমত দরকারী।ইসলাম নারীদের সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা দিয়েছে মা হিসেবে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত’। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার এক লোক মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দরবারে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার বেশি অধিকারী কে? নবীজি (সা.) বললেন, ‘তোমার মা’। ওই লোক জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? তিনি উত্তর দিলেন ‘তোমার মা’। ওই লোক আবারও জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? এবারও তিনি উত্তর দিলেন ‘তোমার মা’। (বুখারি)।আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যব্যহার করতে। তার মা তাকে গর্ভে ধারণ করেছে বড় কষ্টের সঙ্গে এবং তাকে প্রসব করেছে খুব কষ্টের সঙ্গে। তাকে গর্ভধারণ করতে এবং প্রসবান্ত দুধ ছাড়াতে ত্রিশমাস সময় লেগেছে’। (আহকাফ: ১৫)
▪️কন্যা হিসেবে নারীর সম্মানঃ
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মেয়েশিশু বরকত (প্রাচুর্য) ও কল্যাণের প্রতীক।’ হাদিস শরিফে আরও আছে, ‘যার তিনটি, দুটি বা একটি কন্যাসন্তান থাকবে; আর সে ব্যক্তি যদি তার কন্যাসন্তানকে সুশিক্ষিত ও সুপাত্রস্থ করে, তার জান্নাত নিশ্চিত হয়ে যায়।’
▪️বোন হিসেবে নারীর সম্মানঃ
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কারও যদি কন্যাসন্তান ও পুত্রসন্তান থাকে আর তিনি যদি সন্তানদের জন্য কোনো কিছু নিয়ে আসেন, তবে প্রথমে তা মেয়ের হাতে দেবেন এবং মেয়ে বেছে নিয়ে তারপর তার ভাইকে দেবে।’ হাদিস শরিফে আছে, বোনকে সেবাযত্ন করলে আল্লাহ প্রাচুর্য দান করেন।
▪️স্ত্রী হিসেবে নারীর সম্মানঃ
ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে রয়েছে, ‘তারা তোমাদের আবরণস্বরূপ আর তোমরা তাদের আবরণ।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৭)। স্ত্রীর গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘উত্তম স্ত্রী সৌভাগ্যের পরিচায়ক।’ (মুসলিম শরিফ)। তিনি আরও বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে–ই উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।’ (তিরমিজি)। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচরণ করো।’ (সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ১৯)। কোরআনে আরেক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘নারীদের ওপর যেমন অধিকার রয়েছে পুরুষের, তেমনি রয়েছে পুরুষের ওপর নারীর অধিকার।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত ২২৮)। মুসলিম সভ্যতায় পুরুষের চেয়ে নারীর মর্যাদা, মুল্যায়ন, অধিকার কোনক্রমেই কম নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা পুরুষের চেয়েও বেশি। স্ত্রী হিসেবে একজন নারীর জন্য ইসলাম মানবিক অধিকার নিশ্চিত করেছে । পুরুষের জন্য অপরিহার্য করা হয়েছে স্ত্রীর মোহরানা আদায় । এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক এরশাদ করেন, তোমরা স্ত্রীদেরকে তার পারিবারিক জীবনে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশি মনে। সুরা নিসা: ৪।
▪️বিধবার অধিকার ও সম্মানঃ
বিধবাদের অধিকার সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যারা বিধবা নারীর ভরণ–পোষণের দায়িত্ব নেয়, তারা যেন আল্লাহর পথে জিহাদকারী এবং নিরলস নামাজি ও সদা রোজা পালনকারী। (বুখারি ও মুসলিম)।
▪️নারীর প্রতি সম্মান পুরুষের ব্যক্তিত্বের প্রমাণঃ
রাসুলের একটি হাদিসে এসেছে, নারীকে সম্মান করার পরিমাপের ওপর ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টি নির্ভর করে। তিনটি বিষয় নবী করিম (সা.)-এর জীবনে লক্ষণীয় ছিল—এক. নামাজের প্রতি অনুরাগ; দুই. ফুলের প্রতি ভালোবাসা; তিন. নারীর প্রতি সম্মান। (বুখারি ও মুসলিম)।
শেষ কথা, শুধু বছরে একবার নারীদের প্রতি দরদী না হয়ে সারা বছর নারীদের যথাযথ প্রাপ্য আদায়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হওয়া প্রচেষ্টা জরুরি।কিন্তু আজ দিবস পালন হয় ঠিকই, তাহলে নারীর অধিকার দেওয়া হয় না। নারীর মর্যাদা ও সম্মান দেওয়া হয় না। কি লাভ হবে নারী দিবস পালন করে যদি শুধু নারীদের ভোগের ব্যবস্থা করা হয় সেখানে। নারীদের ন্যায্য অধিকারের কথা বলা হয় না। সুতরাং দিবস পালন না করে প্রয়োজন মর্যাদার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আমরা চাই নারীদের মর্যাদা ও অধিকারের ভিত্তিতে গড়ে উঠুক এক সুন্দর সমাজ। নারী দিবস থেকে সেই প্রত্যাশাই আমরা করি। তাহলেই না স্বার্থক হতে পারে দিবস পালন।শুধু লেখায় আর আলোচনায় নয় , সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক এই শুভ কামনা।
আজ বিশ্ব নারী দিবসে এই লেখাটি উৎসর্গ করলাম আমার প্রিয়তম অর্ধাঙ্গিনী নওমি সানজানা কান্তাকে। পুরুষ পুণ্যবান তখনই হয় যদি তার অর্ধাঙ্গিনী পূণ্যবতী হয়।আলহামদুলিল্লাহ সে আমার অপূর্ণতা দুর করে সম্পুন্ন রুপে পূর্ণতা দান করেছে।
—সৈয়দ হোসাইন উল হক

About the author

Syed Hossain ul Haque

সৈয়দ হোসাইন উল হক তরফ ও শ্রীহট্ট বিজয়ী মহান মনিষী সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (রহঃ)এর অধস্থন পুরুষ ‘নবী বংশ পরিচিতি ও মহান কোরবানি’ গ্রন্থের লেখক, হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী সুরাবই সাহেব বাড়ীর সিংহপুরুষ সৈয়দ মোঃ ইসহাক আল হুসাইনী (রহঃ)সাহেবের মেঝ ছেলের ঘরের বড় নাতি।মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাজ্য গমন অতঃপর ইউনিভার্সিটি অফ সান্ডারল্যান্ড থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে অনার্স এবং কুইন মেরী ইউনিভার্সিটি থেকে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস এন্ড পলিটিক্সের উপর এম এস সি। তারপর ২০১৮ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ইসলামিক স্টাডিজ এন্ড হিস্টোরি’তে এম-ফিল। শিক্ষানবিশ কালে সেই সকল বিশ্ববিদ্যালয় সমুহের বিভিন্ন ছাত্র সংঘটনের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন।বর্তমানে লন্ডনে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন পাশাপাশি লন্ডনের একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট ম্যানেজারের দায়িত্বরত।তাছাড়াও যুক্তরাজ্যে একটি ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটর লেকচারার ও গবেষনা কেন্দ্রে অবিরাম বিভিন্ন বিষয়ে গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছেন।আল-কোরআন ও হাদীসের আলোকে “যবহে আজিম এবং জিকিরে শাহাদাত”শীর্ষক গ্রন্থখানা তার দীর্ঘ গবেষনা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল।

মতামত দিন