প্রবন্ধ

আজ হিজরীর ২৫শে রজব নবীবংশের সপ্তম নক্ষত্র ইমাম মুসা বিন জাফর আল কাযিম (আ.)- এর পবিত্র শাহাদাত দিবস।

আজ হিজরীর ২৫শে রজব রসূল (সা.) এর প্রপৌত্র নবীবংশের সপ্তম নক্ষত্র ইমাম মুসা বিন জাফর আল কাযিম (আ.)- এর পবিত্র শাহাদাত দিবসে সকল অনুসারীদেরকে জানাই আন্তরিক শোক‑সমবেদনা ও মহান সত্তার শানে পেশ করছি অশেষ দরুদ ও সালাম।
রসূল পাক (সা.) এর প্রপৌত্র নবীবংশের সপ্তম নক্ষত্র ইমাম মুসা বিন জাফর আল কাযিম (আ.) ১২৮ হিজরির ৭ সফর রবিবার মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থান আবওয়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন।ষষ্ঠ ইমাম জাফর বিন মুহাম্মদ আল সাদিক (আ.) ছিলেন তাঁর পিতা এবং হামিদা আল‑বারবারিয়া (সালামাতুল্লাহ আলাইহা) ছিলেন তাঁর মাতা। তিনি‘আবুল হাসান’ নামেও তাঁর যথেষ্ট পরিচিতি ছিলেন। ইমাম পাকের মূল নাম ছিল মূসা; আল‑কাযিম ছিল তাঁর উপাধি এবং ডাক নাম ছিল আবু ইবরাহীম। মদীনার অধিবাসীরা ইমাম মুসা বিন জাফর আল কাযিম (আ.)-কে  “যাইনুল মুতাহাজ্জেদীন” অর্থাত রাত্রি জাগরণকারীদের সৌন্দর্য উপাধিতে ভূষিত করেছিল।  এই মহান ইমাম এত সুন্দর ও সুললিত কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতেন যে, যে কেউ তা শুনে কেঁদে ফেলত।
ইমাম মূসা আল‑কাযিমের পবিত্র জীবনের প্রথম বিশ বছর অতিবাহিত হয় তাঁর মহান পিতার পবিত্র ও আন্তরিক পৃষ্ঠপোষকতায়।ষষ্ঠ ইমাম জাফর আস‑সাদিক (আ.) ১৪৮ হিজরির ২৫ শাওয়াল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং ঐদিন থেকেইমাম মুসা বিন জাফর আল কাযিম (আ.) সপ্তম ইমাম হিসাবে অভিষিক্ত হন। ৩৫ বছর পর্যন্ত তাঁর ইমামতকাল ছিল কিন্তু তাঁর  ইমামতির জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে কারাগারে ও নির্বাসনে।
আব্বাসীয় শাসকদের বিভ্রান্ত ও দুর্নীতিগ্রস্ত চাল‑চলন যে ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত ধারা  পিতার মতই তা তুলে ধরেছিলেন ইমাম মুসা বিন জাফর আল কাযিম (আ.)। তিনি আব্বাসীয় শাসকদের শত অত্যাচার ও নিপীড়ন এবং কারাদণ্ড ও নির্বাসন সত্ত্বেও ইসলামের সঠিক শিক্ষা প্রচারের আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। এ আন্দোলনের যে বিশেষ ধারা  তাঁর মহান পিতা ইমাম জাফর সাদিক (আ.) শুরু করেছিলেন তা আরও বিকশিত হয়েছিল পুত্রের প্রজ্ঞা, কৌশল ও ত্যাগ‑তিতিক্ষাপূর্ণ অধ্যবসায়ের সুবাদে। বিশেষ করে পবিত্র কুরআনের প্রকৃত তাফসির ও হাদীস বর্ণনা তাঁর মাধ্যমে আরও বিকশিত হয়। তাই আব্বাসিয় শাসকরা চাইতেন না জনগণের সঙ্গে ইমামের যোগাযোগ বৃদ্ধি পাক। তারা জনগণের ওপর নবী বংশের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোর জন্য যে কোনো ধরনের প্রতারণ, প্রচারণা, বর্বরতা ও নৃশংসতার আশ্রয় নিতে দ্বিধা বোধ করত না।

 

ইমাম মুসা বিন জাফর আল কাযিম (আ.)-এর জীবন অতিবাহিত হয় আব্বাসী শাসনের ক্রান্তিকালে। ১৬৪ হিজরিতে আল-মনসুরের পুত্র আল‑মাহদী শাসক হিসাবে একবার মদীনায় আসে এবং ইমাম মূসা আল‑কাযিমের ব্যাপক সুনাম ও সুখ্যাতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁকে বাগদাদে নিয়ে যায় এবং কারাগারে নিক্ষেপ করে। এক বছর পর ইমামকে মুক্তি দেয়। ১৭৯ হিজরিতে আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশীদ মদীনা সফরে এসে মদীনার জনসাধারণের মধ্যে এই মহান ইমামের বিরাট প্রভাব ও বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে হিংসা ও শত্রুতার আগুনে জ্বলে ওঠে। মসজিদে নবীতে নামাযরত অবস্থায় ইমাম পাককে সে গ্রেফতার করে বাগদাদের কারাগারে নিয়ে চার বছর পর্যন্ত আটক করে রাখে এবং আপোষহীন এই ইমামের প্রাণনাশের সিদ্ধান্ত নেয়। ইমাম মুসা বিন জাফর আল কাযিম (আ.)-কে বসরায় ঈসা ইবনে জাফর নামক এক জল্লাদের কারাগারে এক বছর বন্দী রাখা হয়। সেখানে ইমামের উত্তম চরিত্র জাফরের ওপর এমন প্রভাব রাখে যে ওই জল্লাদ হারুনের কাছে এক লিখিত বার্তায় জানিয়ে দেয় যেঃ তাঁকে আমার কাছ থেকে ফিরিয়ে নাও, নতুবা আমি তাঁকে মুক্ত করে দেব। এরপর হারুনের নির্দেশে ইমাম মুসা ইবনে জাফর (আ.)-কে বাগদাদে ফাযল ইবনে রাবির কাছে কারারুদ্ধ করা হয়। এর কিছু দিন পর ফাযল ইবনে ইয়াহিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয় এই মহান ইমামকে। কয়েক দিন পর সেখান থেকেও তাঁকে পাঠানো হয় কুখ্যাত জল্লাদ সানদি ইবনে শাহাকের কারাগারে।
ইমাম মুসা বিন জাফর আল কাযিম (আ.)-কে এক কারাগার থেকে বার বার অন্য কারাগারে স্থানান্তরের কারণ ছিল এটাই যে হারুন প্রতিবারই কারা প্রহরীকে নির্দেশ দিত ইমামকে গোপনে হত্যা করার। কিন্তু তাদের কেউই রাজি হয়নি এ কাজ করতে। অবশেষে সানদি ইমামকে বিষ প্রয়োগ করতে রাজি হয়। বিষ প্রয়োগের তিন দিন পর ১৮৩ হিজরির এমন দিনে  তিনি শাহাদত বরণ করেন। এ সময় ইমামের বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর।  তাঁর লাশের সাথেও মানবিক আচরণ করা হয়নি। কারাগার থেকে বের করে তাঁর পবিত্র মৃতদেহ বাগদাদ সেতুর উপর ফেলে রাখা হয়। ইমামের ভক্ত ও অনুসারীরা তাঁর দেহ সেখানে থেকে নিয়ে গিয়ে ইরাকের কাযিমিয়াতে দাফন করেন। সেখানে ইমাম পাকের মাজার রয়েছে। মুসলমানরা মাজারে গিয়ে আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করে, অনুপ্রাণিত হয় রাসূল ও তার আহলে বাইতের পথ অনুসরণ করতে।

আবারও মহান ইমাম মুসা বিন জাফর আল কাযিম (আঃ)-এর শাহাদাত দিবসে সকল অনুসারীদেরকে জানাই আন্তরিক শোক‑সমবেদনা ও মহান সত্তার শানে পেশ করছি অশেষ দরুদ ও সালাম।

আস সালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা ইয়া মুসাব্-না জাফার, আইয়ুহাল কাযিমু, ইয়াব্-না রাসূলিল্লাহ।ইয়া আবাল হাসানে ইয়া মুসাবনা জাʼফর আইয়োহাল কাজিমো ইয়াবনা রাসূলিল্লহি ইয়া হুজ্জাতুল্লাহি আলা খালক্বেহি, ইয়া সাইয়্যেদানা ওয়া মাওলানা ইন্না তাওয়াজ্জাহনা ওয়া ওয়াস তাশফা’না ওয়া তাওয়াস্ সালনা বিকা ইলাল্লাহি, ওয়া ক্বাদ্দামনাকা বায়না য়্যাদায় হাজাতেনা। ইয়া ওয়াযিহান ইন্দাল্লাহি ইশ ফা‘লানা ইন্দাল্লাহি।”

“আল্লাহুম্মা লা’আন আউয়ালা জালামা মুহাম্মাদ ওয়া আলে মুহাম্মাদ।আল্লাহুমা সাল্লে ‘আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলে মুহাম্মাদ আত তাইয়েবিন আত তাহেরিন ওয়াল মাসুমিন আল মজলুমিন ওয়া লা’নতুল্লাহে ‘আলা আদাইহিম।আল্লাহুমা সাল্লে আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলে মুহাম্মাদ ওয়া আজ্জিল ফারাজাহুম।”

—সৈয়দ হোসাইন ঊল হক


About the author

Syed Hossain ul Haque

সৈয়দ হোসাইন উল হক তরফ ও শ্রীহট্ট বিজয়ী মহান মনিষী সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (রহঃ)এর অধস্থন পুরুষ ‘নবী বংশ পরিচিতি ও মহান কোরবানি’ গ্রন্থের লেখক, হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী সুরাবই সাহেব বাড়ীর সিংহপুরুষ সৈয়দ মোঃ ইসহাক আল হুসাইনী (রহঃ)সাহেবের মেঝ ছেলের ঘরের বড় নাতি।মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাজ্য গমন অতঃপর ইউনিভার্সিটি অফ সান্ডারল্যান্ড থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে অনার্স এবং কুইন মেরী ইউনিভার্সিটি থেকে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস এন্ড পলিটিক্সের উপর এম এস সি। তারপর ২০১৮ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ইসলামিক স্টাডিজ এন্ড হিস্টোরি’তে এম-ফিল। শিক্ষানবিশ কালে সেই সকল বিশ্ববিদ্যালয় সমুহের বিভিন্ন ছাত্র সংঘটনের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন।বর্তমানে লন্ডনে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন পাশাপাশি লন্ডনের একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট ম্যানেজারের দায়িত্বরত।তাছাড়াও যুক্তরাজ্যে একটি ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটর লেকচারার ও গবেষনা কেন্দ্রে অবিরাম বিভিন্ন বিষয়ে গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছেন।আল-কোরআন ও হাদীসের আলোকে “যবহে আজিম এবং জিকিরে শাহাদাত”শীর্ষক গ্রন্থখানা তার দীর্ঘ গবেষনা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল।

মতামত দিন