প্রবন্ধ

মর্সিয়া সাহিত্যে হবিগঞ্জ

মর্সিয়া সাহিত্যে হবিগঞ্জ

 সৈয়দ গাজীউর রহমান ‑সুরাবই সাহেব বাড়ি,হবিগন্জ ।


হায়রে মরমের চান, কেনে দুনিয়ায় আসিলায় রে
[হায়রে] কান্দে দেইখ্যা আশিক যেই জন। (ধুয়া)
[হায়রে হায়] কেন বা কবলা হইল, নবীর বংশের কি ঘটিল,
হায়রে-যার খাতিরে আলম সৃজন।
[হায়রে হায়] যারে আল্লায় সব সপিল, কলায় কেউ না চিনিল,
হায়রে- কে মারিল আমার ভাই হুছন.….….।
[ রচনা : মােঃ আব্দুল হেকিম, চাঁনপুর, হবিগঞ্জ সদর।]

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মােহাম্মদ (সঃ) এর প্রাণ প্রিয় দৌহিত্র এবং হযরত আলী (আ.) এর দ্বিতীয় পুত্র ইমাম হুসায়েন (আ.) এর পরিবারের সদস্য মােট বাহাত্তর জন মােমিন বান্দাহ ফোরাত নদীর তীরে এক বিন্দু পানির জন্যে পিপাসায় কাতর হয়ে কারবালার ধু ধু মরু প্রান্তরে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেন। এই অসম যুদ্ধে ইমাম হুসাইন(আ.) এর কাফেলায় ছিল মাত্র বাহাত্তর জন এবং অপর পক্ষে এজিদের সেনা বাহিনীতে ছিল হাজার হাজার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈনিক। এ অসম যুদ্ধে নিশ্চিত মৃত্যু এবং পরাজয় জেনেও তারা স্বেচ্ছায় সত্যের জন্যে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ছিলেন। তবুও তারা এজিদের গভর্ণর এবং কুফার শাসনকর্তা উবায়দুল্লা বিন যেয়াদের অন্যায় শর্তের কাছে মাথা নত করেননি। শর্ত ছিল, হয় এজিদের আনুগত্য স্বীকার কর নতুবা প্রাণ দাও। সত্য ও ন্যায়ের পথিকগণ প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ন্যায় ও সত্যকেই বেছে নিয়েছিলেন। মহররম সেই নির্মম ঘটনার স্মৃতিবাহী মাস। বর্ষ পরিক্রমায় ঘুরে আসে মহররম মাস। ঐতিহাসিক আশুরার দিন। যে দিনটি বিভিন্ন কারণে বিশ্বের ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয়। ইসলামী বর্ষের প্রথম মাস মহররমের দশ তারিখকে আশুরা বলা হয়।

এই দিনটি মানব জাতির ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যবহ। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু বড় বড় ঘটনা এই তারিখে সংঘটিত হয়েছে। মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) কে আল্লাহপাক এই দিনেই তার প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচন করেছেন। হযরত নূহ (আঃ) এর যমানায় তিনি সাড়ে নয়শত বছর যাবৎ আল্লাহর রাহে মানুষকে আহবান করার পরও যখন তখনকার মানুষ আল্লাহ পাকের বিধি নিষেধ পালনে অস্বীকৃতি জানায়, তখন নেমে আসে আল্লাহর গজব। এক মহাপ্লাবনে তদানীন্তন পৃথিবীর মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। রক্ষা পায় শুধু তাঁরা, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে হযরত নূহ (আঃ) এর তরীতে আরােহণ করে। এই তরী ‘যুদী’ পাহাড়ের পাদদেশে এসে থামে এই ঐতিহাসিক আশুরার দিনেই। আর এই দিনেই হযরত ইব্রাহিম (আঃ)কে আল্লাহ পাক খলিলুল্লাহ বা আল্লাহ্র বন্ধু বলে ঘােষণা করেন। ঘটনাক্রমে একবার হযরত সােলায়মান (আঃ) তাঁর হাতের আংটি হারিয়ে ফেলেছিলেন। ফলে তিনি। সাময়িকভাবে রাজ্যহারা হন। মহররমের ১০ তারিখে অর্থাৎ পবিত্র আশুরার দিনে আল্লাহ। পাক তাঁর রাজত্ব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। হযরত ইউনুছ (আঃ) ইরাকের দজলা নদীতে নিমজ্জিত হলে এক বিরাট মৎস্য তাকে পেটে পুরে নেয়। আল্লাহ পাকের অসীম কুদরতে এই আশুরার দিনেই তিনি মাছের পেট থেকে নাজাত লাভ করেন। এমনি আরও বহু ঐতিহাসিক ঘটনা এই আশুরার দিনে ঘটেছে। হযরত ইউসুফ (আঃ) এর সঙ্গে তার পিতা হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর সাক্ষাৎ হয়েছিল সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর পর এই আশুরারই দিনে। আর হযরত আইয়ূব (আঃ) ছিলেন ধৈৰ্য্য ও সহনশীলতার প্রতীক। সুদীর্ঘ আঠারাে বছর তিনি কুষ্ঠ রােগ ভােগ করেন। অবশেষে এই আশুরার দিনেই তিনি আরােগ্য লাভ করেন। আমাদের পৃথিবীর অস্তিত্ব লাভের সঙ্গেও আশুরার দিনের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কেননা এই দিনেই আল্লাহ পাক সৃষ্টি করেছেন আসমান, জমীন, লওহ কলম। শুধু যে এই পৃথিবী সৃষ্টির সাথেই এ দিনের সম্পর্ক তা নয়, কেননা রােজ কেয়ামত এই আশুরার দিনেই কায়েম হবে। অতএব আশুরার তাৎপর্য বর্ণনাতীত। কিন্তু যে কারণে এই আশুরার দিনটি মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত স্মরণীয় এবং হৃদয় বিদারক তা হলাে কারবালার মরু প্রান্তরে এই দিনেই হযরত ইমাম হােসাইন (আ.)সত্যের জন্য সংগ্রাম করে শাহাদাত বরণ করেছেন। যখন ইসলামী মূল আদর্শের বরখেলাপ করে ইয়াজিদ সিংহাসনে আসীন হয় তখন সত্য ও ন্যায়ের খাতিরে ইমাম হুসাইন (আ.) তার প্রতিবাদে সােচ্চার হন। ইয়াজিদ মদিনার শাসন কর্তাকে নির্দেশ দিলাে ইমাম হােসাইন (আ.) থেকে আনুগত্যের বয়াত গ্রহণ করতে, অন্যথায় শাস্তির ব্যবস্থা নিতে। তখন ইমাম হােসাইন (আ.) এর নিকট থেকে বায়াত আদায় করতে মদিনার শাসনকর্তা চাপ প্রয়ােগ করে। উপায়ান্তর না দেখে ইমাম হােসাইন (আ.)তখন সােনার মদিনা ছেড়ে মক্কায় হিজরত করলেন।

এদিকে কুফাবাসী ইমাম হােসাইন (আ.) এর নিকট এই মর্মে চিঠি লিখলেন যে, আপনি কুফায় আগমণ করুন। আমরা আপনার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছি। প্রায় দেড়শত চিঠি এই মর্মে পৌঁছার পর ইমাম হােসাইন (আ.)অবস্থার সত্যতা যাচাইয়ের জন্যে মােসলেম ইবনে আকীলকে কুফায় প্রেরণ করলেন। ত্রিশ হাজার কুফাবাসী ইমাম হােসাইন (আ.)এর পক্ষে তার হাতে বায়াত গ্রহণ করলাে। ইমাম হােসাইন (আ.)এর নিকট তিনি এই বায়াতের বিবরণ পেশ করে তাঁকে কুফা আগমণের আহবান জানালেন। ইমাম হােসাইন (আ.) তাঁর পরিবারবর্গ সহ রওয়ানা হলেন। তার সঙ্গীদের সংখ্যা ছিল বাহাত্তর জন। পথে এজিদ সৈন্যরা তার পথরােধ করে দাঁড়ালাে। চার হাজার সৈন্যের এই দল সর্বপ্রকার অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। তারা কোন অবস্থায়ই ইমাম হােসাইন (আ.) ও তার সঙ্গীদের কুফার দিকে অগ্রসর হতে দিল না।অবস্থা বিবেচনায় তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। তারা ফোরাত নদীর পানি তাঁর জন্য বন্ধ করে দিল। অবশেষে তিনিও তাঁর সঙ্গীগণ জালিম শত্রুর বিরুদ্ধে জেহাদ করে শাহাদাত বরণ করলেন। তাঁর পবিত্র দেহের তাজা রক্ত প্রবাহিত হলাে কারবালার মরু প্রান্তরে। এভাবে তিনি সত্য ও ন্যায়ের জন্য আমরণ সংগ্রাম করার এক মহান আদর্শ রেখে গেলেন। ফোরাত নদীর তীরের মর্মস্পর্শী ঘটনা অর্থাৎ হযরত ইমাম হােসাইন (আ.)‘র শাহাদাতের স্মৃতিবাহী মাহে মহররমের দিনের সেই ইতিহাস কোনদিন ভুলবার নয়।কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে সাহিত্য রচনা করা শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। এখনাে বাংলা সাহিত্যে বিষয়টি অত্যন্ত সমাদৃত। কারবালার নির্মম ঘটনার কথা স্মরণ করে আজো মানুষ কাঁদে। ইমাম বংশের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার জন্যে এই বেদনা আরাে করুন হয়ে উঠে।বাংলা সাহিত্যে এই বেদনা কাতর অনুভূতির যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছে। মধ্য যুগ থেকে শুরু করে এখনকার সময় পর্যন্ত সাহিত্যের বিষয় হয়ে এসেছে কারবালার কাহিনী। আরবী সাহিত্যে এর প্রথম বিকাশ। ফারসী ও উর্দু সাহিত্যে তা সহজে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা সাহিত্যে এসেছে আরবী, ফারসী ও উর্দুর প্রভাবে। কারবালার বিষাদময় কাহিনী নিয়ে লেখা সাহিত্যের পরিচয় মর্সিয়া সাহিত্য নামে খ্যাতি লাভ করেছে। মর্সিয়া সাহিত্যের মূল বিষয়বস্তু কারবালার ঘটনা। তবে বিষয়টি শুধু কারবালার দুঃখজনক ঘটনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। আরও নানা বিষাদময় কাহিনী এই ধরনের কাব্যের উপকরণ হিসাবে গৃহীত হয়েছে। সে কারণে মর্সিয়া সাহিত্য বলতে সাধারণভাবে শোেক সাহিত্য বােঝায়। এ দেশে মুসলমান শাসন আমলে কারবালার ঘটনাটি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। পরবর্তীকালে মুসলমানগণ রাজ্য হারানাের প্রেক্ষিতে মুসলমানদের দুর্দিনে শােকের পরিচায়ক বলে মর্সিয়া সাহিত্যের সমাদর অব্যাহত থাকে। তাই মর্সিয়া সাহিত্য একদিকে শােক ও অন্যদিকে বীরত্বের কাহিনীর সমাহার। এই বৈশিষ্ট্যের জন্য মর্সিয়া সাহিত্যে কারবালার মূল কাহিনী ছেড়ে খলিফাগণের বিবরণকেও উপকরণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এমন কি যুদ্ধ বিষয়ক রচনা ও মর্সিয়া সাহিত্যের আওতায় এসেছে। মর্সিয়া সাহিত্যের মাধ্যমে মুসলমানদের মনের বেদনা সুন্দরভাবে রূপায়িত হয়ে উঠেছে। তাদের অতীত ঐতিহ্যের প্রতি আকর্ষণের পরিচয় এই ধরনের কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। অতীতের গৌরবের কথাও এখানে বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এদেশে মুঘল শাসনের আমলে মর্সিয়া সাহিত্য রচনা শুরু হয়। পরে ইংরেজ শাসনের আমলেও তা অব্যাহত থাকে। প্রথম দিকের মর্সিয়া সাহিত্যে উল্লেখ করার মত কবি হলেন ঃ দৌলত উজির বাহরাম খান, মুহম্মদ খান, হায়াত মাহমুদ প্রমুখেরা। পরবর্তীকালে ইংরেজ আমলে এই ধারায় কাব্য রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন শাহ গরীবুল্লাহ

মর্সিয়া সাহিত্যের একটি বিশেষ রূপ লাভ করে জারি গানের মধ্যে। জারি গানের জনপ্রিয়তা কারবালার শােকাবহ ঘটনার জন্য। আধুনিক বাংলা গদ্যেও কারবালার কাহিনী উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। মীর মােশারফ হুসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’, হবিগঞ্জের মহাকবি সৈয়দ সুলতানের কিছু রচনায়ও মহররম সম্পর্কে হৃদয় গ্রাহী বর্ণনা পাওয়া যায়।এছাড়া অপরাপর কবিগণের মধ্যে মহাকবি কায়কোবাদের ‘মহরম শরীফ এ প্রসঙ্গে উল্লেখের দাবী রাখে। বাংলা সাহিত্যে মর্সিয়া জাতীয় কাব্য প্রথম রচনা করেছিলেন কবি শেখ ফয়েজুল্লাহ। তার কাব্যের নাম জয়নবের চৌতিশা। শেখ ফয়েজুল্লাহ প্রতিভাশালী কবি ছিলেন। ষােল শতকে এই কাব্যটি রচিত। কাব্যটি আকারে ছােট। কারবালার একটি ছােট ঘটনা এতে স্থান পেয়েছে। কারবালার ঘটনা নিয়ে দৌলত উজির বাহরাম খান কাব্য রচনা করে ছিলেন। তাঁর কাব্যের নাম ‘জঙ্গনামা’ । মর্সিয়া সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট কাব্য ‘মক্কুল হােসেন। কাব্যটি লিখেছিলেন কবি মােহাম্মদ খান। চট্টগ্রামের এই কবি ১৬৪৫ সালে এই কাব্য রচনা করেন। রংপুরের হায়াত মাহমুদ একজন খ্যাতিমান কবি ছিলেন। তিনি আঠারাে শতকে রচনা করেন তার ‘জঙ্গনামা’ কাব্য। কবি হায়াত মাহমুদও একজন প্রতিভাশালী কবি ছিলেন। তাঁর অপরাপর কাব্য ‘চিত্তউথান’, ‘হিতজ্ঞানবাণী’ ও আম্বিয়া বাণী’ । জাফর নামে অন্য একজন কবি। তিনিও মর্সিয়া সাহিত্যে বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। তার বিস্তারিত কোন পরিচয় পাওয়া যায়নি। তার রচিত কাব্যের নাম ‘শহীদ‑ই-কারবালা’ এবং ‘সখিনার বিলাপ’ । মধ্যযুগের খ্যাতিমান কবি আব্দুল হাকিম ও মর্সিয়া সাহিত্যে নিজের অবদান রেখে গেছেন। তাঁর কাব্যের নাম ‘কারবালা’। পুথি সাহিত্যের ধারার কবি ফকির গরীবুল্লার ‘জঙ্গনামা’ নামক অসমাপ্ত কাব্যের রচয়িতা। কাব্যটি মকুল হােসেন নামেও পরিচিত। সতের শতকের প্রথম দিকে এ কবি জীবিত ছিলেন। বাংলা মর্সিয়া সাহিত্যে তাঁর রচনা যথেষ্ঠ | জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। মর্সিয়ার জনপ্রিয়তা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। তাই কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে এখনাে সাহিত্য রচনা হয়ে থাকে। মর্সিয়া সাহিত্যের সমাদরের জন্য ভাষার বিভিন্ন রূপে তা রূপায়িত হয়ে উঠেছে। কখনাে খাটি বাংলা, কখনাে পুথি সাহিত্যের ভাষায়, কখনাে আধুনিক কবিতার ভাষায়, কখনাে গদ্যে সাহিত্যরূপ রাভ করে তার জনপ্রিয়তা প্রমাণ করেছে। দীর্ঘ দিন ধরে এ ধরনের সাহিত্য রচিত হওয়ার পেছনে কারবালার | শশাকাবহ কাহিনী ও ধর্মীয় চেতনা কাজ করেছে। পুরনাে মর্সিয়া সাহিত্যে বাংলাদেশের সমাজ জীবনের ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই ধারার কবিগণ আরবী, ফারসী, উর্দু সাহিত্যের অনুসরণ করলেও নিজের বৈশিষ্ট্য প্রকাশে তৎপর ছিলেন। সেজন্য তাদের কাব্যে এদেশের মুসলমানের তথা মানুষের মনের অনুভূতি বিকশিত হয়েছে।

জারি’মার্সিয়া,ও মাতম।সুলতানশী হাবেলী,হবিগন্জ।

জারি’মার্সিয়া,ও মাতম।সুলতানশী হাবেলী,হবিগন্জ।

হবিগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী অগণিত আশেকে পাঞ্জাতন ভক্তিপুত চিত্তে, জারী, মর্সিয়া ও সালাম রচনা করে তাঁদের হৃদয় উৎসারিত শােক গাঁথার মাধ্যমে একটি নিজস্ব পরিমণ্ডল তৈরী করেছেন। এসব ভক্তজনের রচিত মহররম কেন্দ্রিক সাহিত্যের সঠিক ইতিবৃত্ত রচনার প্রয়াস। অত্যন্ত জটিল বিষয়। যে সকল আশেকে পাঞ্জাতনগণের দ্বারা হবিগঞ্জের মােহাররম বিষয়ক সাহিত্য অর্থাৎ মর্সিয়া সাহিত্য আপন বৈশিষ্ট্যে পল্লবিত ও বিকশিত হয়েছে তাদের মধ্যে সুলতানশী হাবিলীর সৈয়দ আব্দুল করিম হােসেনী চিশতি, সৈয়দ আঃ রহীম হােসেনী চিশতী, সৈয়দ আব্দুর হােসেনী চিশতী, সৈয়দ গােলাম মােস্তফা হােসেনী চিশতী, চানপুরের আব্দুল হেকিম, শরীফপুরের নাছির উল্লাহ, হাতির থানের সিকান্দর আলী গাইন, এরালিয়ার শাহ মােহাম্মদ ইব্রাহিম, আউশপাড়ার সৈয়দ নবাব মিয়া, মসাজানের সৈয়দ আব্দুন নবী উরফে ফুলমিয়া, বামকান্দির কিস্মত আলী চিশতী, গােবিন্দপুরের আদিম উল্লা, ফুলশাহ সাহেবের রওজার খাদেম পুড়াসুন্দা নিবাসী শাহ কলন্দর ফকির( রহ:), সুরাবই গ্রামের রিয়াছত খা, চানপুরের রিফাত উল্লাহ, ভরপুর্ণী গ্রামের মােহাম্মদ গয়েব আলী, শায়েস্তানগরের শাহ আলম। বেলায়েতী, লামাতাউসির আতাব মিয়া, বানিয়াচঙ্গ কাউরিয়া কান্দির শাহ মন্তাজ আলী ও স্নানঘাটের মুনসী জহির উদ্দিনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোেগ্য। এতদব্যতিত আরাে অনেক ভক্ত প্রেমিক রয়ে গেছেন স্থানাভাবে তাদের নাম উল্লেখ করা সম্ভব হলাে না। নাম না জানা সে সব ভক্তের অবদান মর্সিয়া সাহিত্যে আপন গৌরবে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তাঁদের সবার প্রতি রহমতের বারিধারা বর্ষিত হােক।

হবিগঞ্জের মর্সিয়া সঙ্কলন সম্পর্কে একটি সহায়ক তথ্য পরিবেশন করা এখানে একান্ত প্রাসঙ্গিক। সম্প্রতি সৈয়দ হাসান ইমাম হােসেনী চিশতী সাহেবের সম্পাদনায় ১লা মহররম ১৪১১ হিজরী সনে “দীনহীন রচনাবলী” নামে যে মূল্যবান সঙ্কলনটি প্রকাশিত হয়েছে তাতে বহু জারী, মর্সিয়া, সালাম ইত্যাদির সন্ধান পাওয়া যায়। সুরাবই সাহেব বাড়ির সিংহ পুরুষ সৈয়দ মোহাম্মদ ইসহাক আল্ হোসাইনী (রঃ) সারা জীবনের গবেষণার ফসল “নবী বংশ (পাক পাঞ্জাতন) ও মহান কোরবানী” শীর্ষক গ্রন্থ রচনা করেন।

সেই কবে থেকে হবিগঞ্জ অঞ্চলে মর্সিয়ার প্রচলন শুরু হয়েছে, আনুষ্ঠানিক মহরম উদযাপন আরম্ভ হয়েছে সে ব্যাপারে মহররমের প্রাণকেন্দ্র সুলতানশী হাবিলীর জনাব সৈয়দ গােলাম নবী হােসেনী চিশতীর সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় যে, তাদের পূর্বপুরুষ মহাকবি সৈয়দ সুলতান (রঃ) সুলতানশী হাবেলীতে আনুষ্ঠানিক মহররম উদযাপনের সূচনা করেন। চন্দ্ৰচুরি হাবেলীর সৈয়দ খালিদ বকস্ এর সঙ্গে যােগাযােগ করলে জানা যায় যে, তার পূর্ব পুরুষ পীরে কামেল সৈয়দ মােহাম্মদ ইদ্রিস (রঃ) হজ্বব্রত শেষে ইরাকের কারবালাতে হযরত ইমাম হােসাইন (রাঃ) এর মাজার জিয়ারতে যান এবং সেখান হতে ফিরে চন্দ্ৰচুরিতে আনুষ্ঠানিক মহররম উদযাপন শুরু করেন।  মহরমের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র সুরাবই সাহেব বাড়িতে হযরত ফুলশাহর (রঃ) সময় হতেই আনুষ্ঠানিক মহররম পালিত হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বাংলাদেশ মহররম উদযাপন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শাহ্ মিজানুল আলম চিশতী আল কাদরী (শায়েস্তানগর, হবিগঞ্জ) জানান যে, সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্র রাজত্বকাল হতে এ অঞ্চলে মহরম পালন শুরু হয়েছে। তিনি নিজেকে সৈয়দ নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (রঃ) এর অন্যতম সঙ্গী শাহ মজলিশ আমিনের (রঃ) বংশধর হিসেবে দাবী করেন এবং বলেন যে, তাঁর পূর্ব পুরুষ শাহ মােহাম্মদ হেলাল (রঃ) [মৃত্যু ১৭১২ খৃঃ] ইরান, ইরাক এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গা হতে কতেক মর্সিয়া সংগ্রহ করেন যা পরবর্তীতে এ অঞ্চলে প্রচলিত হয় এবং এ ধারা এখনাে অব্যাহত আছে।

আশুরার তাজিয়া মিছিল,সুরাবই সাহেব বাড়ি,হবিগন্জ ।

আশুরার তাজিয়া মিছিল,সুরাবই সাহেব বাড়ি,হবিগন্জ ।

হবিগঞ্জের জারী ও মর্সিয়া গুলিতে আরবী, ফারসী, উর্দু শব্দাবলীর সমাহার পরিলক্ষিত হয়। জারীই হােক কিংবা মর্সিয়া বা সালামই হােক, প্রত্যেকটি পাঞ্জাতন ভক্তদের হৃদয় নিংড়ানাে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ বই কিছুই নয়। এ সমস্ত শােক গাথার ভাষা প্রাঞ্জল, ছন্দ ও শব্দ গাঁথুনী বৈচিত্র্যে ভরপুর, সুর করুনঃণ ও মর্মস্পর্শী।

হবিগঞ্জ এলাকায় সুলতানসী, চন্দ্ৰচুরি, সুরাবই সাহেব বাড়ি ছাড়াও জারী মর্সিয়ার এখনাে চর্চা আছে তেমন কিছু স্থানের নাম উল্লেখ করা গেল। যেমন ঃ চাঁনপুর, বড়কান্দি,মির্যাপুর, নাতিরপুর, আনােয়ারপুর, রিচি, লুকড়া, রায়পুর, ভাটপাড়া, ধল, বামকান্দি, জালালাবাদ, নােয়াগাঁও, কামড়াপুর, কাশিপুর, জয়নগর, কালনী, আশেরা, বেবীটেকা, টঙ্গিঘাট, পৈল, এরালিয়া, পাঁচপাড়িয়া, তেঘরিয়া, ভাদৈ, আউশপাড়া, শরীফপুর, হাতিরথান, চরহামুয়া, নােয়াবাদ, রাঙ্গেরপাও, বহুলা, আদ্যপাশা, মসাজান, দিঘলবাক, যাত্রাবাড়ী, শায়েস্তানগর, অনন্তপুর, মদনপুর, নূরপুর, শ্রীরামপুর, চন্ডিপুর, লাদিয়া, বারলাদিয়া, আলগাপুর, নসরতপুর, পুড়াসুন্দা, শৈলজুড়া, অলিপুর, চারিনাও, শঙ্করপাশা এবং রায়ধর প্রভৃতি সদর থানার উল্লেখযােগ্য।

বানিয়াচঙ্গ থানার ‑সাগরদিঘীর পূর্বপাড় হায়দর শাহের মাজারের সন্নিকটে ‘হুসেনীগড়’ রয়েছে বলে জানা যায়। সেখানে জারী মর্সিয়ার প্রচলন আছে। এছাড়া মিনাট মহল্লা, নােয়াগাঁও, বেতকান্দি, গুনই, কাগাপাশা, অমরপুর, আগােয়া, কাউরিয়াকান্দি, উত্তর সাঙ্গর, বিথঙ্গল, পুকড়া, মুরাদপুর ও ইকরাম প্রভৃতি গ্রাম সমুহ।নবিগঞ্জ থানায় ‑বেতাপুর, তিমিরপুর, কুরশী, পিটুয়া, বামনগাঁও, জিয়াদীপুর, উমরপুর, আলােয়া, জালালপুর ও রােকনপুর প্রভৃতি গ্রাম সমুহ।চুনারুঘাট থানা-ইনাতাবাদ, কালিচুঙ্গ, রজাকপুর, বড়াইল, লালচাঁন, দুবারিয়া, ও মুরাড়বন্দ মাজার শরীফ প্রভৃতি।বাহুবল থানায়-চন্দ্ৰচুরি, মামদনগর, ভােগলী, ভাদেশ্বর, মিরপুর, জয়পুর, ভেড়াখাল, লামাতাশি, বক্তারপুর ও স্নানঘাট প্রভৃতি গ্রাম সমুহ।তেমনিভাবে আজমিরীগঞ্জ থানায়-কাকাইলচেও, জলসুখা, বিরাট, শিবপাশা, ফিরােজপুর, পশ্চিমভাগ, শরীফপুর, নােয়াগাও এবং মাধবপুর থানায়-বেজুড়া, সুলতানপুর, এক্তিয়ারপুর, ফতেহপুর, রিয়াজনগর, মানিকপুর, রাধাপুর এবং লক্ষীপুর ইত্যাদি উল্লেখিত গ্রাম গুলাে ও তদসংলগ্ন অন্যান্য গ্রাম সমুহে পবিত্র আশুরা উপলক্ষে মর্সিয়ার মর্মভেদি সূরে ও ‘হায় হুসেন, হায় হুসেন রবে আকাশ বাতাস ভারাক্রান্ত করে তুলে।

আবহমানকাল ধরে মহররমের মর্সিয়া হবিগঞ্জ অঞ্চলে ইমাম ভক্তদের প্রাণে ভক্তিরসের উৎস হয়ে রয়েছে। হবিগঞ্জের মর্সিয়া সাহিত্যকে আরও গভীরভারে গবেষণা করলে বাংলা সাহিত্যের মরমী ধারায় বিরাট অবদান রাখতে পারে এ কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা শেষ পর্যায়ে দুটি জারীর উদ্ধৃতি দিয়ে এ নিবন্ধের ইতি টানছি।

[এক]
সা’রবানু মাত্তম করইন শিশু কোলে লইয়া রে-মায়ের ধন আসগর আলী রে।
[হায়রে হায়] আমার বাছা নীলমনি রে, পানি পি’তে নাহি দিল রে-
কাল হইল ফুরাতের পানি জাদুয়ার লাগিয়া রে।
[হায়রে হায়] দুই আংখী মেলিয়া চাও, কোলে বইসা দুধ খাও রে-
জাদু তরে ডাকি মায়ে জুওয়াব নাহি দেও রে।
[হায়রে হায়] চাওনা দেখি নয়ন মেলি, শােনাও চান্দ মুখের বুলি রে-
অভাগী মা‘র তাপিত প্রাণী জুড়াউক শুনিয়ারে।
হায়রে হায় না দেখিয়া চান্দ মুখ, বান্ধি কিসে আমার বুক রে
রইল মায়ের মনের দুঃখ কলিজায় বিন্ধিয়া রে।
[হায়রে হায়] কোথায় গেলে তােমায় পাব, কিসে দুঃখ পাশরিব রে-
হাশরেতে কইব দুঃখ নবীজির সাইক্ষ্যাতে রে।
[হায়রে হায়] এই দেশেতে নাইরে আপন, কে করিব কাফন দাফন রে-
বেহেশতী কাফন বুঝি দিবা পাক সােবহানে রে।
[হায়রে হায়] আমিত চির দুঃখিনী, ইমামের ঐ চারণ মাজি রে-
মুই দাসী নি পাইমু দীদার হাসরের দিনে রে।
-সৈয়দ গােলাম মােস্তফা হােসেনী চিশতী, সুলতানশী হাবলি,হবিগঞ্জ।

(দুই)
আল্লা আজগরের লাশ লইয়া বানু মাত্তম জুড়িলারে
ও বাঁচা আজগর কই গেলায় রে।
আল্লা- কুলেতে লইয়া দুধ আর খাওয়াইমু কারে রে!! (ধুয়া)

আল্লা-পানি খাইয়া শান্ত হইয়া কুলেতে আসিবায় রে -
ঐ আশাতে পন্থ পানে রইলাম চাইয়ারে,
আল্লা-পানি নি খাইয়াছ বাচা চান্দ মুখেতে বলরে !!

আল্লা-গলেতে লউয়ের ধারা কেনরে
সর্ব অঙ্গ লউ এ ডুবা কি কারণে রে-
আল্লা-কি গুনাহ করিলাম আমি আল্লাজির দরবারে।।

আল্লা-কোন পাষাণে কোন পরানে এ ডাকাতি করলায় রে
পিয়াসা বালকের গলে কেনে তীর মারিলায়রে,
আল্লা-কই আছে দুরন্ত তীর আনিয়া আমায় দেওরে।।

আল্লা-বুকেতে লাগাইয়া ঐ তীর পরান তাজিব রে
এ ধরাতে এই জীবন আর না রাখিবরে,
আল্লা-পরান ছাড়া হইলা বানু কহিতে বলিতে রে।।
ও বাচা আজগর কই গেলায় রে। 

-শাহ কলন্দর ফকির( রহ:)’ পুরাসুন্দা,হবিগন্জ।

৬১ হিজরীতে কারবালা প্রান্তরে সংঘটিত পৈশাচিক ও হৃদয় বিদারক ঘটনাবলী পর্যালােচনা করলে আজও নূরনবী হযরত মােহাম্মদ মােস্তফা (সঃ) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হােসাইন (রাঃ)’র সীমাহীন আত্মত্যাগের আদর্শই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। একটি উর্দু কবিতায় সেই আত্মত্যাগের মূল্যায়ন কি সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছেঃ

কালে হুসাইন আসলমে মরগে ইয়াজিদ থা
ইসলাম জিন্দা হােতা হ্যায় হর করবালাকে বাদ।
 

হবিগঞ্জ ইতিহাস প্রণয়ন পরিষদ কর্তৃক ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হবিগঞ্জ পরিক্রমা গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত।

মতামত দিন