প্রবন্ধ

তরফের এক আধ্যাত্মিক নক্ষত্র সৈয়দ আব্দুর রহীম হোসাইনী চিশতী (র:)

তরফের এক আধ্যাত্মিক নক্ষত্র সৈয়দ আব্দুর রহীম হোসাইনী চিশতী (র:)

লেখক:-সৈয়দ মসিউল হাসান। দরবার ‑এ — মোস্তফা,সুলতানশী হাবেলী হবিগন্জ।

ওলী বুজুর্গানদের ইবাদতের একটি বড় বৈশিষ্ট হচ্ছে আল্লাহ ও তার রাসূলে পাকের (সা:) প্রেমে নিজেকে নিমগ্ন রাখা। এই কাজটি তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নীরবে, লোক চক্ষুর আড়ালে থেকে করতেই বেশি পছন্দ করেন। আল্লাহ্পাক নিজেও ইবাদতের এই গোপন দিকটিকে ভালোবাসেন। পবিত্র কোরআনের সূরা আরাফ এর ৫৫ নম্বর আয়াতের প্রথম অংশে আল্লাহ্পাক আদেশ করেন, “হে বিশ্বাসীগণ!) বিনয়াবনত চিত্তে ও সংগোপনে তোমার প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করো।” আবার একই সূরার ৫৬ নম্বর আয়াতের দ্বিতীয় অংশে ঘোষণা করেন, “শঙ্কা ও প্রত্যাশা নিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহর অনুগ্রহ সৎকর্মশীলদের খুব কাছাকাছি”। এই পুণ্যবান, সৎকর্মশীল মানুষের প্রসংগে সূরা আল ইমরানের সতেরো নম্বর আয়াতে আল্লাহ্পাক ইরশাদ করেন, “এরা (এক) বিপদে ধৈর্যশীল, (দুই) সত্যবাদী, (তিন) অনুগত, (চার) দাতা এবং রাতের শেষ প্রহরে অন্তরের অন্তস্তল থেকে ক্ষমাপ্রার্থনা করে।” বিনয়াবনত চিত্তে, সংগোপনে, রাতের শেষ প্রহরে প্রার্থনারত এই মহাপুরুষরা আসলে সারাক্ষনই নিমগ্ন থাকেন ইশকে ইলাহী, ইশকে রাসূল (সাঃ) এবং ইশকে আহলে বায়েতে। অপার্থিব এই ইশকের তাজল্লিতে তারা নিজেরাও পরিণত হন আধ্যাতিক জগতের এক একটি নক্ষত্রে। সুলতানশী হাবেলীর সৈয়দ আব্দুর রহিম হোসাইনী চিশতী (র:) ছিলেন এমনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। পিতা সৈয়দ মুহাম্মদ ছাবের এর তিন সন্তান সৈয়দ আব্দুর রহিম (মলাই মিয়া), সৈয়দ আব্দুল আজিম (জলাই মিয়া) ও সৈয়দ আব্দুল করিম (আলাই মিয়া), প্রত্যেকেই উচ্চ স্তরের কামেল অলি ছিলেন। আধ্যাতিক ও রুহানি শক্তি সম্পন্ন এই মহাপুরুষরা শরীয়ত, তরিকত ও মারফতের সকল শাখায় ছিলেন সমানভাবে পারদর্শী।

সৈয়দ আব্দুর রহিম হোসাইনী চিশতী (র:) মলাই মিয়া সাহেব নামেই বেশি পরিচিত। উনি একজন ছালেকে মজ্জুব, কামেল বুজুর্গ ছিলেন। উনার অসংখ্য কেরামতি নিয়ে জনশ্রুতি আছে। এই বুজুর্গ জীবন যাপন করতেন অত্যন্ত সাধাসিধেভাবে। আপাতদৃষ্টিতে সংসারী মনে হলেও মূলত ছিলেন সংসার বিরাগী। উনাকে দেখা যেত সারাক্ষন গোরস্তানের পাশে বসে কোনো এক ভাবনায় নিমগ্ন। সৈয়দ আব্দুর রহিম হোসাইনী চিশতী সাহেব আহলে বয়ত এবং হজরত আলী মুশকিল কুশার খুব বড় আশেক ছিলেন। আমার আব্বা সৈয়দ হাসান ইমাম হোসাইনী চিশতী সাহেব তার সুপরিচিত গ্রন্থ “তরফ এর ইতিকথা“য় মলাই মিয়া সাহেব সম্পর্কে উল্লেখ করেন, ” প্রথম জীবনে তিনি হজরত আলী (ক:) এর অনুসন্ধান করেন। তাকে কোথায় খুঁজে পাওয়া যায় সে চিন্তায় নিজেকে অস্থির করে তুলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি চিটাগং শহরে হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (র:) এর চিল্লার স্থানে গিয়ে চিল্লা নিতে মনস্থ করলেন। তখন পায়ে হাঁটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। কারণ তখন গাড়ি, ঘোড়া ইত্যাদির প্রচলন ছিল না। অদম্য মনোবল ও অসীম সাহসিকতার সাথে তিনি চিটাগংয়ের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। তরফ অঞ্চল থেকে চিটাগং যাওয়ার পথে অনেক পাহাড়, নদী অবস্থিত। যাহোক অনেক কষ্টে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে চিল্লা নিয়ে বসলেন। ৪০ (চল্লিশ) তম দিনে তিনি হজরত আলী (ক:) উনার সামনে দেখতে পেলেন। হজরত আলী (ক:) উনাকে বললেন, ” আমাকে তুমি পেয়েছো, দেখেছো, তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। এখন তোমার এখানে থাকার প্রয়োজন নেই. তুমি তোমার বাড়িতে (সুলতানশীতে) গিয়ে প্রতি রমজান মাসের ২১ তারিখ আমার উরস করো। প্রত্যেক রমজানের উরসে আমাকে সেখানেই পাবে।কথাগুলি বলেই তিনি গায়েব হয়ে গেলেন। সৈয়দ আব্দুর রহিম হোসাইনী চিশতী সাহেব এরপর সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে প্রায় এক মাসে বাড়িতে ফিরলেন। বাড়িতে ফিরেই তিনি অত্যন্ত ভাব গম্ভীর পরিবেশে ২১শে রমজানের উরস উদযাপন করা শুরু করলেন। তিনি হজরত আলী (ক:) আশেকে ওই ২১শে রমজান তারিখে ইন্তেকাল করেন। সেই থেকে ২১শে রমজান তারিখে দুই উরস এক সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে।মলাই মিয়া সাহেব আধ্যাতিক সংগীত রচনা করতেন।  
উনার স্বরচিত বিখ্যাত কালামটি হলো,.…..

“দয়াল রসূল ও হবিব বিনে, ভবে কে আমার।
সকল কুল ছাড়িয়া আমি দয়াল রসূল ধইরাছি চরণ তোমার,
হবিব বিনে ভবে কে আমার।

১. মানুষ জনম বৃথা গেলো রসূল, না দেখলাম নয়নে,
নিজ গুনে দেও হে দেখা, দয়াল রসূল তোমার নিজ গুনে ও
হবিব বিনে ——–
২.কোরানে শুইনাছি নামটি রসূল শফিউল মজনবী,
আপনে আপনে তুমি দয়াল রসূল রহমতুল্লিল আলামিন
হবিব বিনে ————-
৩. আউয়ালে আখেরে আমি কইরাছি ভরসা,
নিজ গুনে করো দয়া, দয়াল রসূল না কইরো নৈরাশ ও
হবিব বিনে —————————-
৪. কাংগাল রহিম কান্দে তোমার চরণে ধরিয়া,
মনে লয় মরিয়া যাইতাম, দয়াল রসূল চান্দ মুখ দেখিয়া ও
হবিব বিনে ভবে কে আমার”।

রাসূলে পাকের (সাঃ) উসিলা নিয়ে স্রষ্টায় সমর্পন বা বিলীন হয়ে যাওয়ার অসাধারণ এক মুনাজাত এই কালামটি। ছোট বেলায় আমাদের দরবারের এক আশেক প্রয়াত ‘ইউনূসের’ (আল্লাহপাক তাকে জান্নাত নসিব করুন) কণ্ঠে শুক্রবারের মাহফিলে তন্ময় হয়ে এই মোনাজাতটি শুনতাম। রাতের শেষ প্রহরে এই কালাম শুনলে যেকোনো আশেকের দুচোঁখ প্লাবিত হয়ে আসবে, বুকের ভেতরে উঠবে উথাল পাথাল ঢেউ। পরবর্তীতে এই আধ্যাত্মিক সংগীত রচনার ধারা অব্যাহত রাখেন উনার সুযোগ্য পুত্র তরফের আরেক সুফী সাধক সৈয়দ আব্দুন্ নূর হোসাইনী চিশতী। উনার “দীনহীন” ছদ্মনামটি পিতা সৈয়দ আব্দুর রহিম হোসাইনী চিশতী সাহেবেরই দেয়া।

অনেক উঁচুস্তরের সাধক, বুজুর্গ সৈয়দ আব্দুর রহিম হোসাইনী চিশতী বিশ্বাস করতেন আল্লাহর দিদার পেতে হলে রাসূলে পাকের (সাঃ ) এর দিদার পেতে হবে। আর রাসূলে পাকের (সাঃ ) এর দিদার পেতে হলে তার আহলে বায়েতের দিদার পেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। উনার ধ্যানে, জ্ঞানে এবং জীবনের সকল অবস্থায় মেনে চলতেন হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) বর্ণিত রাসূলে পাকের (সাঃ) একটি বিশেষ হাদিস, “আল্লাহর জন্য আমার সংগে মহব্বত রাখো এবং আমার মহব্বতের খাতিরে আমার আহলে বায়েতের সংগে মহব্বত রাখো”। সেজন্যই হয়তো মৌলা আলী মুশকিল কুশা (ক:) র নাম উনার জিকিরের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতো। মুশকিল কুশার মহব্বতে বিভোর আল্লাহর এই ওলী জগৎ সংসারের মায়া কাটিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন ২১শে রমজান — হজরত আলী (ক:) এর ইন্তেকালের তারিখে। প্রতি বছর মাহে রমজানের ২১ তারিখ সুলতানশীতে দরবারে মোস্তফার উদ্যোগে উনার উরস অনুষ্টিত হয়। আল্লাহ্পাক এই বুজুর্গদের উসিলায় আমাদেরকেও রাসূলে করিম (সাঃ ) ও তার আহলে বায়েতের প্রতি মহব্বতের রশি আমৃত্যু আঁকড়ে ধরে রাখার তৌফিক দান করুন।

মন্তব্য

  • অনেক উঁচুস্তরের সাধক, বুজুর্গ সৈয়দ আব্দুর রহিম হোসাইনী চিশতী রাহঃ এর অজানা তত্বটি জানানোর জন্য ধন্যবাদ।

  • আল্লাহ পাকের খাস রহমত, হুজুর নবীয়ে পাকের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আহলে বাইত এর খাস নেগাহে করম, ওলী আউলিয়াগনের রুহানী তাওয়াজ্জুহ আপনার নসীব হওক।

  • আল্লাহ পাকের খাস রহমত, হুজুর নবীয়ে পাকের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আহলে বাইত এর খাস নেগাহে করম, ওলী আউলিয়াগনের রুহানী তাওয়াজ্জুহ আমাদের নসীব হওক।

  • অনেক ধন্যবাদ। ইনশাল্লাহ ভবিষ্যতে আপনার সাথে যোগাযোগ হবে আশা করি.

  • সত্যিই মামা, ‘আউয়ালে, আখেরে’ এই ওলীদের নেকনজরে থাকাই আমাদের আশা.

  • হযরত সৈয়দ আব্দুর রহিম আল‑হোসাইনী রহ.উরফে সৈয়দ মলাই মিয়া রহ. এর মত বুজুর্গানেদীনের গুণ কারামত লিখে শেষ করার মত নয়। উনার বড় ভাই নয় কোষা জমিদারি ত্যাগী হয়রত সৈয়দ আব্দুল করিম আল‑হোসাইনী রহ. উরফে সৈয়দ আলাই মিয়া রহ. ও ছোট ভাই হযরত সৈয়দ আব্দুল আজিম আল‑হোসাইনী রহ. উরফে সৈয়দ জলাই মিয়া রহ. উনাদের মূল প্রচার ই ছিলো„,
    “পাঁক পান্জাতন” বলতে কারা? আহলেবায়তে রাসুল দ. তথা ”পাঁক পান্জাতন” কে অনুসরণ অনুকরণসহ ভালবাসার মূল শিক্ষা কোরআন হাদিস ইজমা কিয়াসের মাধ্যমে এবং তাঁরা নিজ নিজ কর্মের দ্বারা সেই প্রেম শিখিয়ে গেছেন এবং নিজেদের স্রষ্টার রঙ্গে রাঙ্গিয়ে আধ্যাত্মিকতার উচ্চস্তরে আশিন হয়ে শতাব্দীকাল ধরেও ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানবতার মুক্তির প্রতিক হয়ে আছেন।পরবর্তী প্রজন্ম হযরত সৈয়দ আব্দুন নুর আল‑হোসাইনী রহ. উরফে “দীনহীন” সৈয়দ আব্দুল হেকীম আল‑হোসাইনী রহ. সৈয়দ গোলাম মস্তফা রহ. সৈয়দ কুতুব উদ্দিন আল‑হোসাইনী চিশতী রহ. সৈয়দ হাসান ইমাম হোসাইনী চিশতী রহ. সহ প্রমুখ বুজুর্গানেদীন সেই পন্থানুসরণ করেই আধ্যাত্মিকতা অর্জনকরে গিয়েছেন। বর্তমানেও সেই ধারাবাহিতা চলমান আর চলবে কেয়ামত তক„„ আল্লাহ আমাদের পূর্ব পুরুষগনের ইজ্জত সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করে চলার তাওফিক দান করুন।।

  • Great arti­cle! The depth of analy­sis is impres­sive. For those want­i­ng more infor­ma­tion, vis­it: LEARN MORE. Look­ing for­ward to the com­mu­ni­ty’s thoughts!

মতামত দিন