প্রবন্ধ

ইমাম মাহদী আল মন্তাজার (আ.) যতক্ষণ আবির্ভূত না হচ্ছেন ততক্ষণ সাধারণ মানুষের বিশেষ করে মুসলমানদের দায়িত্ব কি হবে?

أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ

অর্থাৎঃ “-হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং উলিল আমরের-”।


একটি বিখ্যাত হাদীসে হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ আনসারী(রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেনঃ-যখন কুরআনের সুরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াত খানি নাযিল হলো তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! আমরা আল্লাহর এবং তার রাসূলকে চিনেছি এবং উলিল আমর যার অনুসরণকে আল্লাহ নিজের এবং নিজের পয়গাম্বরের অনুসরণ বলে ঘোষণা করেছেন তারা কারা ? তিনি এরশাদ করলেন, তারা আমার স্থলাভিসিক্ত এবং আমার পর মুসলমানদের ইমাম। তাদের প্রথম হলেন ইমাম আলী বিন আবি তালিব, তার পর হাসান ইবনে আলী মুজতাবা, তার পর আল হোসাইন ইবনে আলী সাইয়্যেদুশ শুহাদা,তার পর আলী ইবনে আল হোসাইন (জয়নুল আবেদীন) তার পর মোহাম্মদ ইবনে আলী আল বাকের। (হে যাবির! তুমি তার দেখা পাবে, যখন তুমি তার সাক্ষাৎ পাবে তখন তাকে আমার সালাম বলবে)। তার পর জাফর ইবনে মোহাম্মদ আস সাদিক, তার পর মুসা ইবনে আল কাজিম, তার পর আলী ইবনে মুসা আর রেজা, তার পর মোহাম্মদ ইবনে আলী জাওয়াদ (আত্ তাকী) তার পর আল ইবনে মোহাম্মদ আল হাদী (আল নাকী), তার পর আল হাসান আল আসকারী এবং সর্বশেষ আমার নাম ও উপাধি বহনকারী যে জগতে আল্লহর প্রমাণ এবং আল্লাহর অস্তিত্বের চিহ্ন বহন করবে। আল্লাহ তাআলা তার মাধ্যমে পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম জয় নিশ্চিত করবেন। সে নিজের ভক্ত ও বন্ধুদের হতে অদৃশ্য হয়ে যাবে কিন্তু তার অদৃশ্য চিরস্থায়ী নয় এবং তার ইমামতের ওপর তারাই দৃঢ় থাকবে যাদের হৃদয়কে আল্লাহ তাআলা ঈমানের জন্য পরীক্ষা করেছেন। তার পবিত্র নাম হবেমোহাম্মদ আল মাহদী।যাবির বর্ণনা করেছেন যে, আমি হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হে রাসূলুল্লাহ! তাঁর অদৃশ্য থাকাকালীন তাঁর অস্তিত্ব দ্বারা তাঁর অনুগতরা কি লাভবান হবে’? তিনি উত্তরে এরশাদ করেন,‘ ঐ আল্লাহর কসম যিনি আমাকে নবুয়্যত দিয়ে পাঠিয়েছেন, সে তোমাদেরকে নিজের নূর দ্বারা আলোকিত করবে, নিজের বেলায়েত দ্বারা তোমাদের উপকার করবে যেমন সূর্য দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়। যখন সূর্য মেঘের আড়ালে থাকে, হে যাবির! এটা আল্লাহ তাআলার রহস্য, ভেদ ও গুপ্ত বিদ্যা, এটা সকলের কাছে প্রকাশ করো না। কিন্তু যারা যোগ্য তাদের কাছে অবশ্যই প্রকাশ করো

সূত্রঃ-সহীহ্ আল বুখারী, খঃ-, হাঃ-৬৭১৬ (আধুনিক); সহীহ্ আল বুখারী, খঃ-১০, হাঃ-৬৭২৯, (,ফাঃ); সহিহুল বুখারী, খঃ-, হাঃ- ৭২২২ (আহলে হাদীস লাইব্রেরী থেকে প্রকাশিত); সহীহ্ মুসলীম, খঃ-, হাঃ-৪৫৫৪, ৪৫৫৫, ৪৫৫৭, ৪৫৫৮ ও ৪৫৫৯ (,ফাঃ); সহীহ্ আবু দাউদ, খঃ-, হাঃ-৪২৩০-৪২৩১ (ইফাঃ); শেইখ সুলাইমান কান্দুযী-ইয়ানাবিউল মুয়াদ্দাত-পৃঃ-৪১৬ (উর্দ্দু)।/কিফয়া আল আসার, পৃঃ–৭, পুরানো প্রিন্ট, কায়রো/আস-সাওয়ায়েকুল মুহরিকা,পৃঃ-১৩; মিশরে মুদ্রিত, কওকাবে দুরির ফি ফাযায়েলে আলী, পৃঃ-১৪৪; সৈয়দ মোঃ সালে কাশাফী, সুন্নি হানাফী, আরেফ বিল্লাহ/ইয়ানাবিউল মুয়াদ্দাত-পৃঃ-৪২৭; (বৈরুত) ইবনে আরাবী- ইবক্বাউল ক্বাইয়্যিম-২৬৬; অধ্যায়, মানাকেবে ইবনে শাহার আশুব, খঃ-, পৃঃ-২৮২; রাওয়ানে যাভেদ, খঃ-, পৃঃ-৭২; কিফায়া আল আসার, খঃ-, পৃঃ-; (পুরানা প্রিন্ট) কিফায়া আল আসার, পৃঃ-৫৩, ৬৯; (কোম প্রিন্ট) গায়াতুল মারাম, খঃ- ১০, পৃঃ-২৬৭; ইসবাতুল হুদা, খঃ-, পৃঃ-১২৩।

সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অস্থিরতা ও সংঘাত, যুদ্ধ, রক্তপাত, বৈষম্যের ক্রমবর্ধমান বিস্তার, অন্যায়‑অবিচার‑জুলুমে গোটা বিশ্ব ছেয়ে যাবে। অবশ্য এসবের মধ্যেও অল্প কিছু মানুষ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দূরদর্শিতার কারণে ধর্মের সঠিক পথে অটল থাকবেন। এ সম্পর্কে ইমাম হাসান আসকারি (আ.) বলেন: জেনে রেখো, ইমাম মাহদির আবির্ভাবের সময় এতটা দেরি হবে যে, মানুষ তার আবির্ভাব সম্পর্কে দ্বিধা-সন্দেহে ভোগা শুরু করবে। তবে যারা নিজেদের ঈমান মজবুত রাখতে পারবে তারা এই সন্দেহে ভুগবে না এবং সব ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে।

আবির্ভাবের পর ইমাম মাহদি (আ.) নিজেই নিজের পরিচয় ঘোষণা করে সবাইকে জানিয়ে দেবেন, নবী-রাসূলদের পথ অনুসরণ করে পৃথিবীতে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আবির্ভূত হয়েছেন। এ সম্পর্কে ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেন: ইমাম মাহদি কাবা শরীফের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেবেন:- হে মানুষ! যাদের হযরত আদম ও হযরত শীষ (আ.)কে দেখার ইচ্ছা আছে তারা আমাকে দেখো। হযরত নূহ ও তাঁর সন্তান সামকে দেখার ইচ্ছা যাদের- তারা আমার দিকে তাকাও। যারা হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর সন্তান ইসমাইলের চেহারা মুবারক দেখার ইচ্ছা পোষণ করো তারা আমার চেহারার দিকে দৃষ্টিপাত করো। যারা হযরত মূসা ও তাঁর সহযোগী ইউশাকে দেখতে চাও তারা আমার দিকে তাকাও। শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও আলী (আ.)কে দেখার ইচ্ছা যাদের তারাও আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করো। আমার দাওয়াতের বাণী শোনো কারণ তোমরা যা কিছু জানো এবং যা কিছু জানো না তার সব খবর আমার কাছে আছে।  এরপর হযরত মাহদি (আ.) অতীতে নবী-রাসূলদের কাছে নাজিলকৃত কিতাব ও সহিফার কিছু অংশ পাঠ করে শোনাবেন। সবশেষে তিনি পবিত্র কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করবেন।

ইমাম জাফর সাদেক (আ.)’র এই ভবিষ্যদ্বাণী থেকে বোঝা যায়, ইমাম মাহদি নবী-রাসূলদের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করতে এবং সবাইকে সে পথ অনুসরণ করে বিজয়ের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্যই পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি যতক্ষণ আবির্ভূত না হচ্ছেন ততক্ষণ সাধারণ মানুষের বিশেষ করে মুসলমানদের দায়িত্ব কি হবে? এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, এই মহান ইমামের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত মুসলমানদেরকে যোগ্য ও পারদর্শী আলেম ও ফকিহদের দিকনির্দেশনা মনে চলতে হবে। তাদের ফতোয়া অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে হবে। আমরা যেমন দুনিয়াবি বিভিন্ন বিষয়াদিতে আলোচ্য বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হই তেমনি ধর্মীয় বিষয়ে এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ অর্থাৎ আলেমদের কাছে যেতে হবে।

এখানেও প্রশ্ন রয়েছে। আমরা কি জীবনের চলার পথের সকল কাজের জন্য আলেম ও ফকিহ, মুজতাহীদের শরণাপন্ন হবো নাকি শুধুমাত্র ধর্মীয় বিষয়ে তাদের মতামত নেবো? এ সম্পর্কে মতামত হচ্ছে, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক’সহ সব বিষয়ে যোগ্য আলেমদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে।তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে-, আল্লাহ নিষ্পাপ ইমামদের অনুপস্থিতিতে উম্মতের নিরুপায়  অবস্থায় ফকীহ আলেমের শরণাপন্ন হওয়ার বিধান যা দ্বিতীয় পর্যায়ের ও বিশেষ  অবস্থার এক বিধান (احكام ثانوي)হিসাবে আলোচ্য সুরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াতটি নাযিল করেন নি; বরং  আয়াতটি প্রথম পর্যায়ের একটি বিধান। অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর নবীর আনুগত্য যেমন  সকল সময় ও সকল অবস্থায় নিঃশর্তভাবে পালনীয়, উলিল আমরের নির্দেশও তেমনি  সর্বকালীন ওসর্বজনীন।

বলা বাহুল্য, গুরুমুখী প্রশিক্ষন ব্যতিত একজন মানুষ কখনই ইনসানে কামেল হতে পারবে না। একজন মানুষ বাহ্যিক শরা-শরীয়তের কিছু ফতুয়া মুখস্ত করে সেই অনুযায়ি জীবন চালাতে পারলেও তার শেষ উদ্দেশ্য যে জিকরে ইলাহি এবং পরম মাহবুবের সাথে মিলন সেটা সে ততক্ষন পর্যন্ত পরিপুর্ন করতে পারে না যতক্ষন না সে একজন মুর্শিদের অধিনে দীর্ঘকাল এই সব কঠোর রিয়াজাত সাধনের মাধ্যমে নিজেকে সেই পর্যায়ের কামেল করে না নেয়। আহলে বাইতের সর্বশেষ ইমাম, ইমাম মাহদী আযযালাল্লাহু তায়ালা ফারাজাহুমুশ শরীফ, একাকি অবস্থান করছেন। মওলার একাকীত্বের শোক তখনি অনুধাবন করা যাবে যখন তারই একজন আম নায়েব এই বিষয়ে আমাদের অবগত করাবেন। রুহানি জগতের মাধ্যমে কিভাবে ইমামের কাছে গিয়ে ইমামকে সান্তনা দেয়া যায় সেই ইরফানি শিক্ষা ও আহলে বাইতের ইমামদের শেখানো উসুল ও ফুরুয়ে দ্বীনের শিক্ষা কেবল একজন মুর্শিদই দিতে পারেন।তাছাডা তাজকিয়াতুন নাফস, রিয়াজাত, সেইর ও সুলুক, ধ্যান তথা মোরাকাবা ওয়া মোশাহাদা, দোয়া মিলাদ,ক্বিয়াম, শাবে সুরুদ, কিয়ামুল্লাইল, ইরফান ও ইসলাহের সবক কেবল একজন মুর্শিদই দিতে পারেন।বলা বাহুল্য, ইলমে তাসাউফ একটি ইলমের নাম। এটি কোন সার্টিফিকেট নয় যে, লোক দেখানোর কোন বিষয়।ইমাম মাহদী (আঃ)- এর আম নিয়াবাতের মাধ্যমে ইরফানি খিলাফত, বেলায়েত এবং ইজাজত হাসিলের পর একজন আরেফ সাধক ইজতেহাদের ক্ষমতা বলে ছবক দিয়ে থাকেন।তারা সবাই তাদের নিজ নিজ যুগে নবীজীর পবিত্র আহলে বাইতের ইমামদেরকে মান্য করেই আল্লাহর অলী হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। কেননা, নবীজীর পবিত্র আহলে বাইতের ইমামরা হচ্ছেন হুজ্জাতুল্লাহি আলাল খালক্ব (সমস্ত সৃষ্টির উপর অকাট্য দলীল)।দ্বীনের একটি স্তম্ভ হচ্ছে খুমস। এই খুমস একজন নিয়াবাতি মুর্শিদের কাছেই পৌছে দিতে হবে। এটাই হল শরিয়তের বিধান। ইমামে যামানা (আঃ) যেভাবে আমাদেরকে ইসলাম ধারন করতে বলেছেন সেভাবে একজন নিয়াবাতি মুর্শিদের অধিনে আমাদের দ্বীন ও আখিরাতকে পরিচালিত করবো ইনশাআল্লাহ।আল্লাহ পাক আমাদের তৌফিক দান করুন।

ওয়া আখিরু দা’ওয়ানা আ’নিল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামিন।

নিবেদনে -
সৈয়দ হোসাইন উল হক

মতামত দিন