প্রবন্ধ যাকাত

বিভিন্ন ফিকাহর দৃষ্টিতে খুমস ও যাকাত।

বিভিন্ন ফিকাহর দৃষ্টিতে খুমস ও যাকাত।

‘খুমস’

ইমামী মাজহাবের ফকীহ্গণ ফিকাহর কিতাবসমূহে ‘খুমস’ শিরোনামে একটি বিশেষ অধ্যায় সংযোজন করেছেন যা ‘যাকাত’ অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে। এ অধ্যায়ের মূল কোরআন মজীদের সূরা আনফালের ৪১ নং আয়াতে নিহিত রয়েছে। এ আয়াতে বলা হয়েছে :

وَاعْلَمُوا أَنَّمَا غَنِمْتُم مِّن شَيْءٍ فَأَنَّ لِلَّـهِ خُمُسَهُ وَلِلرَّ‌سُولِ وَلِذِي الْقُرْ‌بَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ
“তোমরা জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে তোমরা যখন কিছু গণীমতের অধিকারী হবে তখন তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ্,তাঁর রাসূল,(রাসূলের) ঘনিষ্ঠ জন,ইয়াতীম,মিসকিন ও পথিকের জন্য।”

ইমামিগণ এ আয়াতে উল্লিখিত ‘গণীমত’-কে অমুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুসলমানদের হস্তগত হওয়া সম্পদের মধ্যে সীমাবদ্ধ গণ্য করেন না;বরং তারা এতে সাত ধরনের সম্পদকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। নিম্নে এ সম্পর্কে উল্লেখ করা হচ্ছে এবং সেই সাথে অন্যান্য মাজহাবের মতামতও উল্লেখ করা হচ্ছে।

১. যুদ্ধের গণীমত : যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত শত্রু সম্পদ (গণীমত)-এর এক-পঞ্চমাংশ (খুমস) দিতে হবে এ ব্যাপারে ইসলামের পাঁচ মাজহাব অভিন্ন মত ব্যক্ত করেছে।

২. খনিজ দ্রব্য : খনিজ দ্রব্য বলতে তা-ই বোঝায় যা ভূ-গর্ভ বা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উত্তোলন করা হয় যা পৃথিবীর (ভূ-গোলকের) অংশ বলে পরিগণিত এবং যার মূল্য আছে,যেমন : স্বর্ণ,রৌপ্য,সীসা,দস্তা,পারদ,তৈল,গন্ধক ইত্যাদি।

ইমামীদের মতে খনিজ দ্রব্যের মূল্য যদি স্বর্ণের নিসাবের মূল্যের সমান হয়,আর এ ক্ষেত্রে নিসাব হচ্ছে ২০ দিনার অথবা রৌপ্যের নিসাবের মূল্যের সমান হয় যার নিসাব হচ্ছে ২০০ দিরহাম,সে ক্ষেত্রে তার এক-পঞ্চমাংশ (খুমস) অর্থাৎ শতকরা ২০ ভাগ প্রদান করা ওয়াজিব হবে। এর চেয়ে কম মূল্যের হলে খুমস প্রদান ওয়াজিব হবে না।

হানাফীদের মতে খনিজ দ্রব্যের ক্ষেত্রে কোন নিসাব নেই;বরং কম বা বেশি হোক,সর্বাবস্থায়ই খুমস প্রদান করা ওয়াজিব।

মালিকী,শাফেয়ী ও হাম্বলীদের মতে খনিজ দ্রব্য যদি নিসাবের চেয়ে কম হয় তাহলে কিছুই দিতে হবে না,কিন্তু তা যদি নিসাব পরিমাণ হয় তাহলে শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে।

৩. গুপ্তধন : গুপ্তধন হচ্ছে এমন জায়গায় মাটির নীচে প্রোথিত সম্পদ যার অধিবাসীরা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং যে সম্পদের মালিককে চি‎হ্নিত করা বা খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। যেমন প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রত্নসম্পদ উদ্ধারের লক্ষে খনন কার্য চালিয়ে যা উদ্ধার করেন।

এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের মত হচ্ছে,গুপ্তধনের খুমস দেয়া ওয়াজিব এবং এ ক্ষেত্রে কোন নিসাব নেই। অতএব,কম হোক বা বেশি হোক,সর্বাবস্থায় খুমস প্রদান করা ওয়াজিব হবে।

ইমামী মাজহাবের মতে গুপ্তধন খনিজ দ্রব্যের মতই এবং উভয়ের খুমস ওয়াজিব হওয়া ও নিসাবের পরিমাণ অভিন্ন।

৪. সমুদ্র তলদেশের সম্পদ : ইমামীদের মতে ডুব দিয়ে সমুদ্র তলদেশ থেকে যা তুলে আনা হয়,যেমন:মুক্তা ও প্রবাল‑এ সবের উত্তোলন ব্যয় বাদে মূল্য এক দীনার হলে খুমস দিতে হবে।

আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের দৃষ্টিতে এ ক্ষেত্রে কিছুই দিতে হবে না-তা উত্তোলিত সম্পদের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন।

৫. প্রয়োজনাতিরিক্ত আয় : ইমামীদের মতে ব্যক্তির নিজের ও তার পরিবার‑পরিজনের সাংবৎসরিক প্রায়োজন পূরণের পর যে অর্থ অবশিষ্ট থাকে-তা যে পন্থায়ই উপার্জিত হয়ে থাকুক না কেন,যেমন ব্যবসায়,চাকরি,দিনমজুরি,জমি-জমা ও বাড়িঘর থেকে লব্ধ আয় দান বা অন্য কোন পন্থায় অর্জিত হয়ে থাকুক,তা থেকে যদি ক্ষুদ্রতম মুদ্রা পরিমাণও অবশিষ্ট থেকে থাকে তাহলে তার খুমস দিতে হবে।

৬. হালাল‑হারামের মিশ্রণ : কারো কাছে যদি হারাম সম্পদ আসে এবং তা তার হালাল সম্পদের সাথে মিশে যায় কিন্তু হারাম সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে তার জানা না থাকে অথবা তার মালিক কে ছিল তাও জানা না থাকে,তাহলে তার ঐ সম্পদ থেকে আল্লাহর রাস্তায় খুমস দিতে হবে। সে যখন তা প্রদান করবে অতঃপর বাকী সম্পদ তার জন্য হালাল হবে,এ ক্ষেত্রে হারাম সম্পদের পরিমাণ প্রদত্ত খুমসের তুলনায় কম হোক বা বেশি হোক। কিন্তু যদি সেই হারাম সম্পদ সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারে তাহলে তাকে সে সম্পদই দিতে হবে। আর যদি হারাম সম্পদকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম না হয় এবং তার সঠিক পরিমাণ বা মূল্য জানা থাকে তাহলে তাকে সতর্কতার সাথে সে পরিমাণই আলাদা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মোটেই কম করা যাবে না,এমন কি তা তার সমস্ত সম্পদের সাথে মিশ্রিত হয়ে থাকলেও। আর যদি তার জানা থাকে যে,কাদের সম্পদ তার সম্পদের সাথে মিশ্রিত হয়েছে,কিন্তু কি পরিমাণ সম্পদ মিশ্রিত হয়েছে তা তার জানা না থাকে,তাহলে তার দায়িত্ব হচ্ছে তাদের সাথে আপোষ করে ও ছাড় দিয়ে হলেও তাদের সন্তুষ্ট করা। মোট কথা,যখন কারো সম্পদের সাথে হারাম সম্পদ মিশে যায় কিন্তু ঐ সম্পদের মালিক ও পরিমাণ সম্পর্কে জানা থাকে না তখন ঐ সম্পদ থেকে খুমস দিতে হবে।

৭. ইমামীদের মতে কোন যিম্মি (ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিক) যখন কোন মুসলমানের নিকট থেকে জমি ক্রয় করবে তখন ঐ যিম্মীকে তার খুমস প্রদান করতে হবে।

খুমসের ব্যবহার:-

শাফেয়ী ও হাম্বলী মতে গণীমত অর্থাৎ খুমসকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করতে হবে। এর প্রথম অংশ রাসূল (সা.)-এর এবং তা মুসলিম জনগণের কল্যাণের কাজে ব্যবহার করতে হবে। এক অংশ ‘যিল কুরবা’ অর্থাৎ রাসূলের আত্মীয়‑স্বজনদেরকে দিতে হবে;এখানে ‘যিল কুরবা’ হচ্ছে পিতার দিক থেকে যারা হাশিমের বংশধর;এ ক্ষেত্রে ধনী-গরীবে কোন পার্থক্য নেই। বাকী তিন অংশ ইয়াতীম,মিসকিন ও পথিকদের জন্য ব্যয় করতে হবে-তা তারা বনি হাশিমভুক্ত বা তার বহির্ভূত হোক,এতে কোন পার্থক্য নেই।

হানাফীদের মতে রাসূলের অংশ তাঁর ইন্তেকালের সাথে সাথেই বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু ‘যিল কুরবা’ বলতে তাঁদের মধ্যকার দরিদ্রদেরকে বোঝানো হয়েছে। অন্য দরিদ্রদের মত দরিদ্র হবার কারণেই তাঁদেরকে দিতে হবে,রাসূলের আত্মীয় হবার কারণে নয়।

মালিকীদের মতে খুমস-এর বিষয়টি মুসলমানদের ইমাম (শাসক)-এর হাতে ছেড়ে দিতে হবে এবং তিনি যেভাবে এর ব্যবহার উত্তম মনে করেন সেভাবেই ব্যবহার করবেন।

ইমামীদের মত হচ্ছে নিঃসন্দেহে আল্লাহ্,রাসূল (সা.) ও ‘যিল কুরবা’-এর তিন অংশ মাসুম ইমাম বা তাঁর প্রতিনিধির নিকট প্রত্যর্পণ করতে হবে এবং তিনি মুসলমানদের কল্যাণার্থে তা ব্যবহার করবেন। বাকী তিন অংশ বনি হাশিমের ইয়াতীম,মিসকিন ও পথিকদের দিতে হবে,এতে তাঁদের ছাড়া অন্যদের কোন অংশ নেই।

আশশে’রানী (الشعراني) লিখিত الميزان গ্রন্থের ‘যাকাত’ অধ্যায় থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আমরা এ অধ্যায়ের আলোচনা শেষ করতে চাই। শেরানী বলেন,“ইমামের দায়িত্ব হচ্ছে নিজ বিবেচনা অনুযায়ী খনিজ মালিকদের খনিজ সম্পদের একটি অংশ বায়তুল মালে প্রদানে বাধ্য করা যাতে খনিজ মালিকদের ধন-সম্পদ এত বৃদ্ধি না পায় যে,তারা ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দাবী করে বসতে পারে এবং সৈন্যদের জন্য ব্যয় করে (তাদেরকে ঘুষ দিয়ে) বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে…।”
এটি একটি আধুনিক তত্ত্বেরই ভিন্নতর প্রকাশ। এ তত্ত্ব অনুযায়ী পুঁজি পুঁজিমালিকদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের দিকে এগিয়ে দেয়। উক্ত মত প্রকাশক (শে’রানী) এখন (১৩৮৩ হিজরী) থেকে ৪০৬ বছর পূর্বে ইন্তেকাল করেন।

[অত্র প্রবন্ধটি আল্লামাহ জাওয়াদ মুগনিয়ার (الفقه على المذاهب الخمسة) গ্রন্থের الزكاةالخمس অধ্যায় দুটির অনুবাদ। মূল আরবী গ্রন্থটি কাযিম পুর জাওয়াদী কর্তৃক ফার্সীতেফেকহে তাতবিকী মাজাহেবে পাঞ্জগনেহ্শিরোনামে অনুবাদ ও তেহরান থেকে প্রকাশিত।জ্যোতি, ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা।]

“যাকাত”

যাকাত দু ধরনের : সম্পদের যাকাত ও শরীরের যাকাত। এ ব্যাপারে পাঁচ মাজহাবের মত অভিন্ন। যাকাতের নিয়তে প্রদত্ত হয় নি এমন দানকৃত সম্পদকে পরে যাকাত হিসেবে গণ্য করলে যাকাত আদায় হবে না। যাকাত ওয়াজিব হবার শর্তাবলী নিম্নরূপ :

সম্পদে যাকাত ওয়াজিব হবার শর্তাবলী সম্বন্ধে বিভিন্ন মাজহাবের মতামত :

১. হানাফী ও ইমামীদের মতে যাকাত ওয়াজিব হবার জন্য সম্পদের মালিকের বিচার‑বুদ্ধিসম্পন্ন ও বালেগ হওয়া অপরিহার্য। অতএব,পাগল ও নাবালেগের সম্পদে যাকাত ওয়াজিব হবে না।২ কিন্তু মালিকী,শাফেয়ী ও হাম্বলীদের মতে যাকাত ওয়াজিব হবার জন্য বিচার‑বুদ্ধিসম্পন্ন ও বালেগ হওয়া শর্ত নয়। পাগল ও নাবালেগ শিশুর সম্পদেও যাকাত ওয়াজিব হবে এবং তার ওয়ালী (অভিভাবক)-এর দায়িত্ব হচ্ছে তার সম্পদ থেকে যাকাত প্রদান করা।

২. হানাফী,শাফেয়ী ও হাম্বলীদের মতে অমুসলিমদের সম্পদে যাকাত প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু ইমামী ও মালিকীদের মতে তাদের ওপরও মুসলমানদের মতই যাকাত প্রযোজ্য হবে এবং এ ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য নেই।

৩. যাকাত ওয়াজিব হবার জন্য সম্পদে পূর্ণ মালিকানা থাকা অপরিহার্য। পূর্ণ মালিকানার সংজ্ঞা সম্বন্ধে প্রতি মাজহাবেই বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সকল মাজহাবের মধ্যে যা অভিন্ন তা হচ্ছে,সম্পদের ওপর মালিকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। অর্থাৎ সম্পদ তার হাতে থাকতে হবে যাতে সে এ সম্পদকে যেমন খুশী ব্যয় ও ব্যবহার করতে পারে। অতএব,হারিয়ে যাওয়া সম্পদে যাকাত ওয়াজিব হবে না। বর্তমানে যে সম্পদ তার মালিকের নিকট থেকে কেউ জবরদখল করে নিয়েছে যদিও আইনত তার মালিকানা বহাল রয়েছে তাতেও যাকাত ওয়াজিব হবে না। প্রদত্ত ঋণের ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না যতক্ষণ না তা পুনরায় মালিকের হাতে আসে। উদাহরণস্বরূপ,স্ত্রীর দেনমোহর যা এখনো স্বামীর যিম্মায় রয়েছে তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে না। কারণ ঋণের অর্থ মালিকের হাতে না আসা পর্যন্ত তাতে যাকাত ওয়াজিব হয় না। ঋণ সংক্রান্ত বিধি-বিধান সম্বন্ধে পরে আলোচনা করা হবে।

৪. খোসাযুক্ত খাদ্য‑শস্যাদি,ফলমূল ও খনিজ দ্রব্যাদি বাদে অন্যান্য সম্পদের ক্ষেত্রে অবিচ্ছিন্নভাবে এক চান্দ্র বছর মালিকানা থাকতে হবে। এ ব্যাপারে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

৫. নিসাব (যাকাত ওয়াজিব হবার জন্য সম্পদের ন্যূনতম পরিমাণ) পূর্ণ হতে হবে। যাকাত ওয়াজিব হবার জন্য বিভিন্ন ধরনের সম্পদের নিসাবের পরিমাণ স্বতন্ত্র। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বিবরণ পরে আসছে।

৬. ঋণী ব্যক্তির নিকট নিসাবের পরিমাণ সম্পদ রয়েছে;এমতাবস্থায় তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে কি হবে না? অন্য কথায় ঋণ কি যাকাত প্রদানে বারণ করবে?

এ ব্যাপারে ইমামী ও শাফেয়ী মাজহাবের মত হচ্ছে,যাকাত ওয়াজিব হবার জন্য সম্পদ ঋণমুক্ত হওয়া শর্ত নয়। অতএব,ঋণী ব্যক্তিকেও যাকাত দিতে হবে,এমন কি তার পুরো নিসাব পরিমাণ ঋণ থাকলেও।

ইমামীদের মতে কোন ব্যক্তি যদি কারো কাছ থেকে নিসাব পরিমাণ যাকাতযোগ্য সম্পদ ঋণস্বরূপ গ্রহণ করে এবং তার কাছে এক বছর থাকে,তাহলে ঋণ গ্রহণকারীর ওপর যাকাত প্রদান ওয়াজিব হবে।

হাম্বলীদের মতে ঋণ যাকাত বারণ করে। যার ঋণ আছে সে যদি সম্পদের অধিকারী হয়,তাহলে তাকে প্রথমে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অতঃপর অবশিষ্ট সম্পদ যদি নিসাবের সমপরিমাণ হয়,তাহলে তাকে যাকাত দিতে হবে,অন্যথায় দিতে হবে না।

মালিকীদের মতে ঋণ স্বর্ণ‑রৌপ্যের যাকাত প্রতিহত করে,কিন্তু খাদ্যশস্য,পশু সম্পদ ও খনিজ দ্রব্যের যাকাত প্রদানে ব্যক্তিকে বারণ করে না। অতএব,যে ব্যক্তির ঋণ আছে ও তার কাছে নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ ও রৌপ্য আছে তাকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে এবং তার ওপরে যাকাত ওয়াজিব হবে না। কিন্তু কেউ যদি ঋণী হয় এবং তার কাছে স্বর্ণ ও রৌপ্য বাদে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে তাহলে তাকে যাকাত দিতে হবে।

হানাফীদের মতে তার যিম্মায় থাকা ঋণ যদি আল্লাহর হক হয়ে থাকে এবং মানুষের কাছে ঋণী না হয়ে থাকে,যেমন তার ওপর যদি হজ্ব ওয়াজিব হয়ে থাকে বা সে কাফ্ফারাহ্ পরিশোধ না করে থাকে,তাহলে এ ঋণ যাকাত বারণ করবে না। আর সে যদি মানুষের কাছে ঋণী হয়ে থাকে অথবা যদি আল্লাহর কাছে ঋণী থাকে কিন্তু তা পরিশোধ করা অনিবার্য হয়ে থাকে,যেমন অতীতের যাকাত বাকী থাকে যা মুসলমানদের শাসক (ইমাম) দাবী করছেন তাহলে তা কৃষিজাত দ্রব্যাদি ও ফলমূল ছাড়া অন্য সব কিছুর ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে যাকাত দিতে হবে না।

এ ব্যাপারে সকল মাজহাব অভিন্ন মত পোষণ করে যে,অলংকারাদি,মূল্যবান পাথর,বসবাসের বাড়ী-ঘর,পোশাক‑পরিচ্ছদ,গার্হস্থ্য সামগ্রী,আরোহণের জন্য ব্যবহৃত চতুষ্পদ জন্তু,অস্ত্রশস্ত্র ও ব্যক্তির প্রয়োজনীয় জিনিস,যেমন যন্ত্রপাতি,বই‑পুস্তক ও হাতিয়ারপত্রের ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়।ইমামিগণ আরো বলেন,স্বর্ণ‑রৌপ্যের পাত থাকলে তার ওপরে যাকাত ওয়াজিব হয় না।

যেসব সম্পদে যাকাত ওয়াজিব হয়:-

পবিত্র কোরআন সম্পদশালীদের সম্পদে দরিদ্রদের প্রকৃত অংশীদার গণ্য করেছে। এ প্রসঙ্গে সূরা আয‑যারিয়াতের ১৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে :
و في اموا لهم حق للسائل و المحروم
“আর তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের (মাহরুম) অধিকার রয়েছে।”
এ ক্ষেত্রে কোরআন মাজীদ কৃষি,শিল্প ও ব্যবসায়ের মধ্যে কোন পার্থক্য করে নি। এ কারণেই সকল মাজহাবের ফকীহ্গণই পশু সম্পদ,খাদ্যশস্য,ফলমূল,নগদ অর্থ ও খনিজ দ্রব্যে যাকাত ওয়াজিব গণ্য করেছেন। তবে যাকাতযোগ্য সম্পদের কতক ধরন নির্ধারণ এবং অপর কতকের নিসাব নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য হয়েছে। এ ছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে দরিদ্রদের অংশ নির্ধারণে মতপার্থক্য রয়েছে।

ইমামী মতে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে মুনাফার এক-পঞ্চমাংশ অর্থাৎ শতকরা ২০ ভাগ যাকাত দিতে হবে। কিন্তু আহলে সুন্নাহর চার মাজহাবের মতে ব্যবসায়ের সম্পদের (বা পুঁজির) চল্লিশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে।খনিজ দ্রব্যের ক্ষেত্রে হানাফী,ইমামী ও হাম্বলীদের মত হচ্ছে,এক-পঞ্চমাংশ (খুমস) প্রদান করতে হবে। আর অন্য দুই মাজহাবের মতে শতকরা আড়াই ভাগ দিতে হবে। যে সব ক্ষেত্রে মতৈক্য রয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণেও মতৈক্য রয়েছে,মতপার্থক্য ঘটে নি।

পশু সম্পদের যাকাত:-সর্বসম্মত মত হচ্ছে,তিন ধরনের পশু সম্পদের ওপর যাকাত ওয়াজিব। তা হচ্ছে উট,গরু-যার মধ্যে মহিষও অন্তর্ভুক্ত এবং মেষ‑ছাগলও যার অন্তর্ভুক্ত। আর এ ব্যাপারে মতৈক্য রয়েছে যে,ঘোড়া,খচ্চর ও গাধার ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়,তবে তা যদি ব্যবসায়ের পণ্য হিসেবে কেনা-বেচা করা হয় তাহলে যাকাত ওয়াজিব হবে। তবে হানাফী মতে ঘোড়ার জন্য যাকাত কেবল তখনই প্রযোজ্য হবে যখন পুরুষ ও মাদী ঘোড়া দুই‑ই থাকে।

পশু সম্পদের যাকাতের শর্তাবলী;-পশু সম্পদের যাকাতের ক্ষেত্রে চারটি শর্ত রয়েছে। তা হচ্ছে :

১.নিসাব হওয়া:-

উটের যাকাতের নিসাব : ৫টি উটের জন্য ১টি দুম্বা (মেষ),১০টি উটের জন্য ২টি দুম্বা,১৫টির জন্য ৩টি দুম্বা এবং ২০টির জন্য ৪টি দুম্বা-এ ব্যাপারে পাঁচটি মাজহাব অভিন্ন মত পোষণ করে। কিন্তু উটের সংখ্যা ২৫টি হলে সে ক্ষেত্রে ইমামীদের মতে ৫টি দুম্বা যাকাতস্বরূপ দিতে হবে। কিন্তু আহলে সুন্নাহর চার মাজহাবের মতে দ্বিতীয় বছরে পড়েছে এমন একটি উষ্ট্রী যাকাত দিতে হবে। ইমামীদের মতে উটের সংখ্যা ২৬ হলে তখন দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণকারী একটি উষ্ট্রী যাকাতস্বরূপ দিতে হবে।
উটের সংখ্যা ওপরে বর্ণিত যে কোন একটি হলেই তা একটি নিসাব বলে গণ্য হবে।
উটের সংখ্যা ৩৬ হলে সর্বসম্মত মত অনুযায়ী তৃতীয় বর্ষে পদার্পণকারী একটি উষ্ট্রী যাকাতস্বরূপ দিতে হবে।
উটের সংখ্যা ৪৬টিতে উন্নীত হলে সর্বসম্মত মত অনুযায়ী চতুর্থ বর্ষে পদার্পণকারী একটি উষ্ট্রী দিতে হবে।
উটের সংখ্যা ৬১ হলে সর্বসম্মত মত অনুযায়ী পঞ্চম বছরে পদার্পণকারী একটি উষ্ট্রী দিতে হবে।
উটের সংখ্যা ৭৬ হলে সর্বসম্মত মত অনুযায়ী তৃতীয় বছরে পদার্পণকারী দু’টি উষ্ট্রী দিতে হবে।
উটের সংখ্যা ৯১ তে দাড়ালে সর্বসম্মত মত অনুযায়ী চতুর্থ বছরে পদার্পণকারী দু’টি উষ্ট্রী দিতে হবে।
সকল মাজহাব এ ব্যাপারে অভিন্ন মত পোষণ করে,উটের সংখ্যা ৯১টির বেশি হলে অতিরিক্ত কিছু দিতে হবে না যদি না তা ১২১টিতে দাড়ায়। ১২১টিতে দাড়ালে সে ক্ষেত্রে প্রতিটি মাজহাবেরই বিস্তারিত বক্তব্য রয়েছে। এ বিষয়ে জানার জন্য ফিকাহ্শাস্ত্রের বিধানসম্বলিত গ্রন্থাদি দেখা যেতে পারে।
এ ব্যাপারে সকল মাজহাব একমত,উটের সংখ্যা ৫টির নীচে হলে যাকাত দিতে হবে না,তেমনি দু’টি নিসাবের মধ্যবর্তী সংখ্যার জন্য অতিরিক্ত যাকাত দিতে হবে না। উদাহরণস্বরূপ,৫টি উটের জন্য একটি মেষ এবং ৯টি মেষের জন্যও ১টি মেষ যাকাত দিতে হবে। তেমনি ১০টি উটের জন্য ২টি মেষ এবং ১৪টি উটের জন্যও ২টি মেষ দিতে হবে। বাকী নিসাবসমূহের মাঝামাঝি সংখ্যার ক্ষেত্রেও এই একই নিয়ম।

গরু-মহিষের নিসাব;- ৩০টি গরু/মহিষের জন্য ১টি গরু/মহিষ,৪০টির জন্য ১টি পূর্ণ বয়স্ক গরু/মহিষ,৬০টির জন্য ২টি বাচ্চা,৭০টির জন্য ১টি পূর্ণ বয়স্ক ও ১টি বাচ্চা,৮০টির জন্য ২টি পূর্ণ বয়স্ক,৯০টির জন্য ৩টি বাচ্চা,১০০টির জন্য ১টি পূর্ণ বয়স্ক ও ২টি বাচ্চা,১১০টির জন্য ২টি পূর্ণ বয়স্ক ও ১টি বাচ্চা এবং ১২০টির জন্য ৩টি পূর্ণ বয়স্ক গরু/মহিষ যাকাত হিসাবে দিতে হবে। পরবর্তী সংখ্যাসমূহের ক্ষেত্রে একই নিয়মে হিসাব করতে হবে। এ ছাড়া দুই নিসাবের মধ্যবর্তী সংখ্যার জন্য অতিরিক্ত কিছু দিতে হবে না। গরু/মহিষের নিসাবের ক্ষেত্রে এটিই সকল মাজহাবের সর্বসম্মত মত।
কিন্তু বাচ্চা ও পূর্ণ বয়স্ক গরু/মহিষের সংজ্ঞার ব্যাপারে মতপার্থক্য আছে। মালিকী বাদে বাকী চার মাজহাবের মতে যে গরু/মহিষের বয়স এক বছর পূর্ণ হয়ে দ্বিতীয় বছরে পড়েছে এখানে বাচ্চা বা বাছুর বলতে তাই বোঝানো হয়েছে। আর যে গরু/মহিষের বয়স দুই বছর পূর্ণ হয়ে তৃতীয় বছরে পড়েছে তাকে পূর্ণ বয়স্ক গণ্য করতে হবে। কিন্তু মালিকী মাজহাবের মতে যে গরু/মহিষের বয়স দুই বছর পূর্ণ হয়ে তৃতীয় বছর শুরু হয়েছে বাচ্চা বলতে তাকেই বোঝায় এবং যার বয়স তিন বছর পার হয়ে চতুর্থ বছরে পড়েছে তাই পূর্ণ বয়স্ক গরু/মহিষ।

ছাগল‑ভেড়ার নিসাব;-সকল মাজহাবের অভিন্ন মত অনুযায়ী ৪০টি মেষ (দুম্বা) [ছাগলও যার অন্তর্ভুক্ত]-থেকে একটি পূর্ণ বয়স্ক মেষ/ছাগল যাকাত দিতে হবে। ১২১টির জন্য দিতে হবে ২টি এবং ২০১টির জন্য ৩টি।
ইমামীদের মতে মেষ/ছাগল সংখ্যা ৩০১টিতে উন্নীত হলে যাকাতস্বরূপ ৪টি দিতে হবে। ৪০০টি পর্যন্ত এ পরিমাণই যাকাত দিতে। অতঃপর প্রতি ১০০টির জন্য ১টি করে মেষ/ছাগল যাকাত দিতে হবে।
কিন্তু আহলে সুন্নাহর চার মাজহাবের মতে ৩০১টির যাকাত ২০১টির যাকাতের সমান অর্থাৎ ৩টি। অতঃপর ৪০০টি পর্যন্ত যাকাত দিতে হবে ৪টি। এর চেয়ে বেশি হলে প্রতি ১০০টির জন্য ১টি করে যাকাত দিতে হবে।
এ ব্যাপারেও সকল মাজহাব একমত,কোন পর্যায়েই দুই নিসাবের মধ্যবর্তী সংখ্যাসমূহের জন্য কোন অতিরিক্ত যাকাত দিতে হবে না।

২. বিচরণশীল হওয়া:-যেসব পশু বছরের বেশির ভাগ সময়ই বৈধ (মোবাহ্) জায়গায় বিচরণ করে ঘাস,আগাছা ইত্যাদি ভক্ষণ করে এবং মালিকের পক্ষ থেকে কদাচিৎ ঘাস সংগ্রহ করে খেতে দিতে হয় সেসব পশু সম্পদের ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। মালিকী মাজহাব ব্যতিরেকে বাকী চার মাজহাবের সর্বসম্মত মত এটি। কিন্তু মালিকীদের মতে বিচরণশীল ও অবিচরণশীল নির্বিশেষে সকল পশু সম্পদের ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে।

৩. পশু সম্পদের মালিকানা এক বছর পূর্ণ হওয়া:-পশু সম্পদের ওপর যাকাত ওয়াজিব হবার জন্য সারা বছর নিসাব সংখ্যক পশুকে মালিকের মালিকানাধীন থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ,এক ব্যক্তি বছরের শুরুতে ৪০টি মেষের মালিক ছিল,কিন্তু কয়েক মাস পর মৃত্যু,দান বা বিক্রির কারণে তা নিসাব সংখ্যার নীচে নেমে গেল,পরে আবার চল্লিশটি পূর্ণ হলো,এ ক্ষেত্রে বছরের শেষে ঐ সব পশুর জন্য যাকাত ওয়াজিব হবে না;বরং নতুন বছর আসতে হবে। ইমামী,শাফেয়ী ও হাম্বলীরা এ ব্যাপারে মতৈক্য পোষণ করে। কিন্তু হানাফীদের মতে বছরের মাঝখানে যদি নিসাবের চেয়ে কম হয়ে যায়,অতঃপর বছরের শেষে পুনরায় নিসাব পূর্ণ হয়,তাহলে যাকাত ওয়াজিব হবে,ঠিক যেভাবে সারা বছর নিসাব সংখ্যক পশু মালিকের হাতে থাকলে ওয়াজিব হয়।
আর শরীয়তের দৃষ্টিতে বর্ষ পরিক্রমা বলতে চান্দ্র বর্ষ পরিক্রমা বোঝায় অর্থাৎ বারটি চান্দ্র মাস।

৪. কাজে না খাটানো:-যাকাত ওয়াজিব হবার আরেকটি শর্ত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট পশু কাজে খাটানোর জন্য নির্ধারিত না থাকা। উদাহরণস্বরূপ চাষাবাদের কাজে ব্যবহার্য গরু ও বাহন হিসেবে ব্যবহার্য উট। অতএব,কাজে ব্যবহৃত পশুর ওপর তা যে পরিমাণ কাজই করানো হোক না কেন,যাকাত ওয়াজিব হবে না। এ ব্যাপারে মালিকী বাদে বাকী চার মাজহাব অভিন্ন মত পোষণ করে। কিন্তু মালিকীদের মতে পশু দিয়ে কাজ করানো হোক বা না হোক,যাকাত ওয়াজিব হবে-এ ব্যাপারে কোন পার্থক্য হবে না।
সকল মাজহাব এ ব্যাপারে মতৈক্য পোষণ করে,কোন ব্যক্তির মালিকানাধীনে যদি বিভিন্ন ধরনের পশু সম্পদ থাকে এবং কোনটিই নিসাবের সংখ্যক না হয়,তাহলে এক ধরনের পশুকে আরেক ধরনের পশুর সাথে যোগ করে নিসাব হিসাব করা ওয়াজিব নয়। কাজেই কারো মালিকানায় যদি ৩০টির কম গরু ও ৪০টির কম মেষ থাকে তাহলে গরুর সাথে মেষ যোগ করে বা মেষের সাথে গরু যোগ করে নিসাব হিসাব করা ওয়াজিব হবে না।
দুই ব্যক্তির যৌথ মালিকানাধীন নিসাবে যাকাত ওয়াজিব হবে কিনা এ ব্যাপারে মতপার্থক্য হয়েছে। এ ব্যাপারে ইমামী,হানাফী ও মালিকী মাজহাবের মত হচ্ছে,যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের প্রত্যেকে আলাদাভাবে নিজ অংশে নিসাবের মালিক হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ওপর যৌথভাবে বা স্বতন্ত্রভাবে যাকাত ওয়াজিব হবে না। কিন্তু শাফেয়ী ও হাম্বলীদের মতে যৌথ সম্পদ নিসাবের পরিমাণ হলে তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে যদিও এর অংশীদারদের প্রত্যেকের অংশ নিসাবের চেয়ে কম হয়।

স্বর্ণ‑রৌপ্যের যাকাত:-ইসলামের সকল মাজহাবের ফকীহ্গণের মতে স্বর্ণ ও রৌপ্য নিসাব পরিমাণ হলে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। তাঁদের মতে স্বর্ণের নিসাব হচ্ছে ২০ মিসকাল৪ এবং রৌপ্যের নিসাব ২০০ দিরহাম৫। সেই সাথে শর্ত হচ্ছে,নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ বা রৌপ্য পূর্ণ এক বছর এর মালিকের হাতে থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে যাকাতের পরিমাণ হচ্ছে শতকরা আড়াই ভাগ।

ইমামীদের মতে স্বর্ণ ও রৌপ্য যদি মুদ্রা আকারে হয়,কেবল তখনই তাতে যাকাত ওয়াজিব হয়। স্বর্ণ‑রৌপ্যের পাত বা অলংকারের ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়। কিন্তু আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের অভিন্ন মত হচ্ছে,স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার মতই স্বর্ণ ও রৌপ্য দণ্ডের ওপর যাকাত ওয়াজিব। কিন্তু স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলংকারের ওপর যাকাত ওয়াজিব কিনা এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে;একদল বলছে ওয়াজিব হবে,আরেকদল বলছে ওয়াজিব হবে না।
স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার যাকাত সম্পর্কে শুধু এতটুকু আভাসই যথেষ্ট বলে মনে করি। কারণ বর্তমানে এর কোন বাস্তব কার্যকারিতা নেই। অন্যদিকে অর্থের প্রতিনিধিত্বকারী কাগজপত্র (الأوراق المالية‑কাগজের নোট,চেক,বন্ড,ইত্যাদি) সম্বন্ধে ইমামীদের মত হচ্ছে,এতে খুমস ওয়াজিব হবে অর্থাৎ সাংবৎসরিক ব্যয়ের পর যা অতিরিক্ত থাকবে তার এক-পঞ্চমাংশ দিতে হবে। এ সম্পর্কে পরে বিস্তারিত আলোচনা আসছে। শাফেয়ী,মালিকী ও হানাফী মাজহাবের মতে এ ক্ষেত্রে অন্যান্য শর্ত পূরণ না হলে অর্থাৎ নিসাব পূর্ণ না হলে ও পুরো এক বছর হাতে না থাকলে যাকাত ওয়াজিব হবে না।
হাম্বলীদের মতে অর্থের প্রতিনিধিত্বকারী কাগজপত্রের ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না যতক্ষণ না তা স্বর্ণ বা রৌপ্যে পরিবর্তিত করা হয়।

কৃষিজাত দ্রব্যাদি ও ফলের যাকাত:-এ ব্যাপারে সকল মাজহাব অভিন্ন মত পোষণ করে যে,কৃষিজাত দ্রব্যাদি ও ফলমূলের এক-দশমাংশ যাকাত দেয়া ওয়াজিব যদি তা বৃষ্টির পানি বা প্রবাহিত নদী-নালা ও খালের পানি দ্বারা সিঞ্চিত হয়ে থাকে।৬ কিন্তু যদি খননকৃত কূপের পানি বা এরূপ অন্য কোন উৎসের পানি দ্বারা সিঞ্চিত হয়ে থাকে তাহলে বিশ ভাগের এক ভাগ বা শতকরা ৫ ভাগ যাকাত দিতে হবে।
হানাফী মাজহাব বাদে অন্য চার মাজহাবের অভিন্ন মত হচ্ছে,খাদ্যশস্য ও ফলমূলের নিসাব হচ্ছে পাঁচ ওয়াসক। আর এক ওয়াসক হচ্ছে ৬০ ছায়ের সমান। ফলে মোট পরিমাণ (৫ ওয়াসক) দাড়াচ্ছে প্রায় ৯১০ কিলোগ্রাম।৭ আর এক কিলোগ্রাম হচ্ছে এক হাজার গ্রামের সমান। এর চেয়ে কম হলে যাকাত ওয়াজিব হবে না।কিন্তু হানাফী মাজহাব মতে খাদ্যশস্য ও ফলমূল কম বা বেশি হোক,তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে-কম‑বেশিতে পার্থক্য হবে না।কোন্ কোন্ ধরনের কৃষিজাত দ্রব্য ও ফলমূলে যাকাত ওয়াজিব হবে এ ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে।

হানাফী মাজহাব মতে জমি থেকে যেসব ফলমূল ও কৃষিজাত দ্রব্য উৎপন্ন হয় তার মধ্যে লাকড়ি,কাঠ ও নল খাগড়া ব্যতীত সব কিছুর যাকাত দিতে হবে।

মালিকী ও শাফেয়ীদের মতে যেসব জিনিষ খরচ করার জন্য জমা করে রাখা হয়,যেমন গম,যব,ধান,খেজুর,শুষ্ক আঙ্গুর ইত্যাদি-এসবের ওপর যাকাত ওয়াজিব।

হাম্বলীদের মতে যেসব ফলমূল ও কৃষিজাত দ্রব্য ভক্ষণ করা ও জমিয়ে রাখা যায় তার ওপরে যাকাত ওয়াজিব।
ইমামীদের মতে খাদ্যশস্যের মধ্যে গম ও যব এবং ফলমূলের মধ্যে শুষ্ক আঙ্গুর ও খেজুর ছাড়া অন্য কিছুর ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়। এছাড়া অন্যান্য বস্তুর ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়,তবে তা প্রদান করা মুস্তাহাব।

ব্যাবসায়িক পণ্যের যাকাত:-ব্যাবসায়িক পণ্য হচ্ছে সেই সম্পদ,লাভের উদ্দেশ্যে বিনিময়ের মাধ্যমে যার মালিকানা অর্জিত হয়েছে এবং মালিক তার নিজের কর্মতৎপরতার মাধ্যমে এর মালিক হয়েছে। অতএব,কেউ যদি উত্তরাধিকারসূত্রে কোন সম্পদের মালিক হয়ে থাকে তাহলে তা ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে গণ্য হবে না। এ ব্যাপারে সকলের মতৈক্য রয়েছে।
আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের মতে ব্যবসায়িক পণ্যের যাকাত ওয়াজিব। কিন্তু ইমামীদের মতে তা মুস্তাহাব। আর যাকাত দিতে হবে কেনা-বেচার পণ্যের মূল্যের ওপর।৮ দেয় যাকাতের পরিমাণ হবে চল্লিশের একাংশ বা শতকরা আড়াই ভাগ।
এ ব্যাপারে ঐকমত্য (ইজমা) রয়েছে,ব্যবসায়িক পণ্যের যাকাতের শর্ত হচ্ছে ব্যবসা শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর এক বছর পূর্ণ হওয়া এবং এ সময় এ পরিমাণ পণ্য মালিকের অধিকারে থাকা। অতঃপর যখন বছর পূর্ণ হবে তখন ব্যবসায়ে লাভ হয়ে থাকলে যাকাত প্রযোজ্য হবে।

এ ব্যাপারে ইমামীদের মত হচ্ছে বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিনিযোগকৃত পুঁজি হাতে থাকতে হবে। বছরের মাঝে কোন সময় পুঁজি কমে গেলে যাকাত প্রযোজ্য হবে না। পুনরায় পুঁজির মূল্য বৃদ্ধি পেলে সেই বৃদ্ধির সময় থেকে বছর গণনা করতে হবে।

শাফেয়ী ও হাম্বলীদের মতে বছরের শেষই হচ্ছে মানদণ্ড,সারা বছরের অবস্থা বিবেচ্য বিষয় নয়। সুতরাং বছরের প্রথম দিকে ও বছরের মাঝে পরবর্তী সময়ে যদি নিসাব না থাকে,কিন্তু বছরের শেষে নিসাব পূর্ণ হয় তাহলে যাকাত দিতে হবে।

হানাফীদের মতে বছরের দুই প্রান্ত হচ্ছে মানদণ্ড,বছরের মধ্যবর্তী সময় নয়। অতএব,বছরের শুরুতে যদি নিসাব থাকে,এরপর বছরের মাঝে তা কমে যায় কিন্তু বছরের শেষে তা পুনরায় পূর্ণ হয় তাহলে যাকাত ওয়াজিব হবে। কিন্তু যদি বছরের শুরুতে বা শেষে নিসাব অপূর্ণ থাকে তাহলে যাকাত ওয়াজিব হবে না।
এ ক্ষেত্রে শর্ত নির্ধারিত হয়েছে,ব্যবসায়িক পণ্যের পরিমাণ নিসাব পরিমাণ হতে হবে। কাজেই পণ্যের মূল্যায়ন করতে হবে। আর ব্যবসায়িক পণ্যের নিসাব হচ্ছে স্বর্ণ মুদ্রা বা রৌপ্য মুদ্রার নিসাবের যে কোনটির সমমূল্য হওয়া। পণ্যের মূল্য তার সমান বা বেশি হলে যাকাত ওয়াজিব হবে,কিন্তু এতদুভয়ের মধ্যে যে নিসাবের মূল্য কম অর্থাৎ রৌপ্য‑ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্য তার চেয়ে কম হলে যাকাত প্রযোজ্য হবে না। ‘আল‑ফিক্হু আলাল মাজাহিবিল আরবাআহ’ (১৯২২ সালে প্রকাশিত) গ্রন্থের লেখকগণ এ নিসাবের পরিমাণ হিসাব করে মিসরীয় মুদ্রায় ৫২৯ কারশ্ ও এক কারশের তিন ভাগের দুই ভাগ বলে নির্ধারিত করেছেন।

যাকাত কি মালিকের দায়িত্বে নাকি সরাসরি সম্পদে?

এ ব্যাপারে ইসলামের মাজহাবসমূহের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে,যাকাত কি সরাসরি সম্পদের ওপর প্রযোজ্য অর্থাৎ সম্পদের অংশীদারগণ যেভাবে সম্পদে সরাসরি হকদার,যাকাতও সেভাবে সম্পদে শরীকরূপে গণ্য হবে? নাকি অন্যান্য দেনার মত তা প্রদান করা সম্পদের মালিকের দায়িত্ব যদিও তা তার সম্পদ থেকে দেয়,যেমন মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে তার দেনা পরিশোধ করতে হয়?
শাফেয়ী,ইমামী ও মালিকী মাজহাবের মতে যাকাত সরাসরি সম্পদে প্রযোজ্য হয় এবং আল্লাহ্তায়ালার বাণী فِي اموا لهم حق للسائل و المحروم (তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে) অনুযায়ী ও মুতাওয়াতির হাদীস ان الله امرْ ك بين الاغنياء و الفقراء في الأموال (নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে ধন-সম্পদে অংশীদারিত্ব দিয়েছেন) অনুযায়ী দরিদ্ররা ধন-সম্পদের অংশে প্রকৃত বা যথার্থ মালিক। তবে শরীয়ত অনুগ্রহপূর্বক সম্পদের মালিককে এ অনুমতি দিয়েছে যে,যেসব ধন-সম্পদে যাকাত ওয়াজিব নয় তা থেকেও দরিদ্রদের এ অধিকার প্রত্যর্পণ করতে পারবে। হানাফী মাজহাবের মতে যাকাত সরাসরি যাকাতযোগ্য সম্পদে প্রযোজ্য ঠিক যেভাবে বন্ধকী মালের ওপর বন্ধক বর্তায় এবং এর অধিকারীকে তা প্রত্যর্পণ না করা পর্যন্ত তার এই অধিকার বিলুপ্ত হয় না।
আর ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল থেকে দু’টি রেওয়ায়েত আছে,তার মধ্যে একটিতে বর্ণিত অভিমত হানাফীদের অনুরূপ।

যাকাতের বিভিন্ন ধরনের হকদার (অধিকারী):

এ ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে,যাকাতের হকদারগণ আট শ্রেণীর এবং তা কোরআন মজীদের সূরা আত‑তাওবাহর ৬০ তম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে। এ আয়াতে এরশাদ হয়েছে :
إنّما الصدقاذ للفقراء و المساكين و العاملين عليها و المؤلفة قلوبهم و في الرقاب و الغارمين و في سبيل الله و ابن السّيل
“নিঃসন্দেহে সাদাকাহ্সমূহ হচ্ছে দরিদ্র, অতি অভাবী, সাদাকাহ্ সংগ্রহের জন্য নিয়োজিত কর্মচারী,যাদের অন্তর জয় করা উদ্দেশ্য, ক্রীতদাস (তাদের মুক্তিপণের জন্য), ঋণভারাক্রান্ত ব্যক্তিগণের জন্য এবং আল্লাহর পথে ও (অর্থকষ্টে পতিত) পথিক মুসাফিরদের জন্য।”

তবে এসব শ্রেণীর হকদারের সংজ্ঞা সম্বন্ধে মাজহাবসমূহের বিভিন্ন বক্তব্য রয়েছে। এখানে তা উল্লেখ করা হচ্ছে:

১। দরিদ্র (ফকীর):-হানাফী মতে ফকীর হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে নিসাবের চেয়ে কম পরিমাণ সম্পদের অধিকারী,এমন কি সে যদি সুস্থ‑সবল হয় এবং উপার্জনের অধিকারীও হয়। কিন্তু যে ব্যক্তি তার মৌলিক প্রয়োজন ব্যতীত অর্থাৎ তার বাসগৃহ,গার্হস্থ্য সামগ্রী ও পোশাক‑পরিচ্ছদ ব্যতীত অন্য যে কোন ধরনের ধন-সম্পদে নিসাবের পরিমাণ মালিক হয় তার জন্য যাকাত গ্রহণ করা জায়েয হবে না। এর পক্ষে দলিল হচ্ছে,নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের জন্য যাকাত প্রদান করা ওয়াজিব,আর যার ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়েছে তাকে যাকাত প্রদান করা ওয়াজিব হতে পারে না।
অন্য সকল মাজহাবের মতে এখানে প্রয়োজনই হচ্ছে মানদণ্ড,সম্পদ নয়। অতএব,যে অন্যের মুখাপেক্ষী বা অভাবী নয় তার জন্য যাকাত গ্রহণ করা হারাম যদিও সে কোন সম্পদের মালিক না হয়ে থাকে। অন্যদিকে অভাবী বা মুখাপেক্ষী ব্যক্তির জন্য যাকাত গ্রহণ করা বৈধ,এমন কি সে যদি এক বা একাধিক নিসাবের মালিক হয়ে থাকে তবুও। কারণ “দারিদ্র্য” কথাটির মানে হচ্ছে “প্রয়োজন/অভাব”। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন,يا أيّها النّاس انتم الفقراء الى الله“হে মানবকুল! তোমরা আল্লাহর নিকট ফকীর।” এখানে ‘ফকীর’ মানে মুখাপেক্ষী।
শাফেয়ী ও হাম্বলী মতে যে তার অর্ধেক প্রয়োজন পূরণে সক্ষম সে দরিদ্র হিসেবে পরিগণিত নয় এবং তার জন্য যাকাত গ্রহণ করা জায়েয নয়।
ইমামী ও মালিকীদের মতে শরীয়তের দৃষ্টিতে ফকীর বা দরিদ্র হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে নিজের ও পরিবার‑পরিজনের সাংবৎসরিক প্রয়োজন পূরণের মত সম্পদের অধিকারী নয়। অতএব, যে ব্যক্তি পানি বা জমি বা পশু সম্পদের অধিকারী কিন্তু তা তার সাংবৎসরিক প্রয়োজন পূরণের জন্য যথেষ্ট নয় তাকে যাকাত দেয়া জায়েয আছে।
ইমামী, শাফেয়ী ও হাম্বলীদের মতে যে ব্যক্তি উপার্জনে সক্ষম তার জন্য যাকাত গ্রহণ করা বৈধ নয়। কিন্তু হানাফী ও মালিকী মতে তার জন্য যাকাত গ্রহণ করা জায়েয এবং তাকে তা দেয়া হবে।
ইমামী মতে যে ব্যক্তি নিজেকে দরিদ্র বলে দাবী করে দৃশ্যত সে যদি ধন-সম্পদের মালিক না হয়ে থাকে এবং সে মিথ্যাবাদী বলেও জানা না থাকে তাহলে কোনরূপ অকাট্য প্রমাণ দাবী করা বা শপথ গ্রহণ ব্যতীতই তার দাবী সত্য বলে গণ্য করতে হবে। কারণ হযরত রাসূল (সা.) সাদাকাহ্ বণ্টন করার সময় তাঁর নিকট দুই ব্যক্তি এসে তাদেরকে সাদাকাহ্ থেকে কিছু দান করার জন্য অনুরোধ জানালে তিনি চোখ তুলে তাদের দিকে তাকালেন এবং বললেন, “তোমরা চাইলে আমি তোমাদেরকে দেব, কিন্তু এতে সম্পদশালীদের ও উপার্জনের অধিকারীর কোন অংশ নেই।” অতঃপর তিনি তাদের কাছে থেকে তাদের দাবীর সপক্ষে কোন অকাট্য প্রমাণ বা শপথ গ্রহণ দাবী না করে তাদের ওপরই যাকাত গ্রহণের সিদ্ধান্তের বিষয়টি ছেড়ে দিলেন।

২. মিসকিন:-ইমামী, হানাফী ও মালিকীদের মতে যে ব্যক্তির অবস্থা ফকীরের চেয়েও খারাপ সেই ব্যক্তি মিসকিন।
হাম্বলী ও শাফেয়ীদের মতে বরং ফকীরের অবস্থা মিসকিনের চেয়ে খারাপ। কারণ ফকীর হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার কোন ধন-সম্পদ নেই বা যার প্রয়োজনের অর্ধেক পরিমাণ সম্পদও নেই। অন্যদিকে মিসকিন হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার প্রয়োজনের অর্ধেক জিনিস সে নিজেই পূরণ করতে সক্ষম। অতএব, যাকাত থেকে তার প্রয়োজনের বাকী অর্ধেক পূরণ করা হয়।
সে যা হোক, ফকীর ও মিসকিনের ব্যাখ্যায় বিভিন্ন মাজহাবের মতের মূল তাৎপর্যের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কারণ যাকাত দ্বারা অভাবী ব্যক্তির বাসস্থান, খাদ্য, পোশাক, চিকিৎসা ও শিক্ষা এ ধরনের অন্যান্য জরুরী প্রয়োজন পূরণ করা হয়।
মালিকী বাদে সকল মাজহাব এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করে যে, যার জন্য যাকাত ওয়াজিব তার জন্য পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, সন্তান‑সন্ততি, নাতি-নাতনী ও নিজ স্ত্রীকে যাকাত দেয়া জায়েয নয়। কিন্তু মালিকী মাজহাব মতে দাদা-দাদী ও নাতি-নাতনীদেরকে যাকাত দেয়া জায়েয। কারণ মালিকী মতে ব্যক্তির জন্য তাদের ভরণ‑পোষণ (নাফাকাহ্) বহন করা ওয়াজিব নয়।
সবাই এ ব্যাপারে একমত যে, ভাই, চাচা ও মামাদেরকে যাকাত দেয়া জায়েয আছে।
যাকাতদাতার পিতা ও সন্তানকে ফকীর ও মিসকিনের অংশ থেকে যাকাত দেয়া জায়েয নেই; কিন্তু তারা যদি এ দু’টি শ্রেণী ব্যতীত অন্য কোন শ্রেণীভুক্ত হয় তাহলে তাদের জন্য যাকাত গ্রহণ জায়েয হবে। যেমন যাকাতদাতার পিতা বা পুত্র যদি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদরত থাকে অথবা যদি “আল মুআল্লাফাতু কুলুবিহিম” (যাদের অন্তরকে জয় করার প্রয়োজন আছে) শ্রেণীভুক্ত হয়ে থাকে বা শারয়ী দৃষ্টিতে বৈধ কারণে ঋণী হয়ে থাকে অথবা শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যতিব্যস্ত থাকে অথবা যাকাত আদায়ের কাজে নিয়োজিত থাকে তাহলে তারা যাকাত নিতে পারবে। কারণ এই শ্রেণীর লোকেরা ধনী বা গরীব হোক, তাদের জন্য যাকাত গ্রহণ বৈধ। (তাযকেরাতুল উলামা, ১ম খণ্ড, যাকাত অধ্যায়)
সে যা হোক, যাকাতদাতার ওপর ভরণ‑পোষণ বহন করা ওয়াজিব নয় এমন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়‑স্বজন যাকাত লাভের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার রাখে এবং তাদেরকে যাকাত প্রদান করা অধিকতর উত্তম।
এক শহর থেকে অন্য শহরে যাকাত পাঠানোর প্রশ্নে মাজহাবসমূহের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। হানাফী ও ইমামীদের মতে যে শহরের যাকাত সেখানকার লোকেরাই তা পাবার অগ্রাধিকার রাখে এবং তাদেরকে দেয়াই অধিকতর উত্তম। তবে যদি এমন কোন অপরিহার্য প্রয়োজন দেখা দেয়‑যে কারণে অন্য শহরে যাকাত পাঠানোর অগ্রাধিকার তৈরি হয় তাহলে তা সেখানে পাঠাতে হবে।
কিন্তু শাফেয়ী ও মালিকীদের মতে এক শহর থেকে অন্য শহরে যাকাত পাঠানো জায়েয নেই।
হাম্বলীদের মতে যে শহরে গেলে নামায কসর হয় না সেখানে যাকাত পাঠানো জায়েয আছে। কিন্তু নামায কসর হবার দূরত্বে অবস্থিত শহরে যাকাত পাঠানো হারাম।
যাকাত কর্মিগণ
যাকাত কর্মী হচ্ছে তারা যারা যাকাত সংগ্রহের জন্য পরিশ্রম করে। এ ব্যাপারে ইসলামের সকল মাজহাব অভিন্ন মত পোষণ করে।
যাদের অন্তর জয় করা উদ্দেশ্য
“আল মুআল্লাফাতু কুলুবিহিম” (যাদের অন্তরকে আকর্ষণ করা হয়) বলতে সেই লোকদেরকে বোঝায় যাদেরকে ইসলামের স্বার্থে যাকাত থেকে একটি অংশ দিতে হয়। কিন্তু এ হুকুম এখনো কার্যকর রয়েছে,নাকি মানসুখ (রহিত) হয়েছে এ প্রশ্নে মতপার্থক্য রয়েছে। যদি হুকুম মানসুখ না হয়ে থাকে তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে অন্তর আকর্ষণের বিষয়টি কি শুধু অমুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য,নাকি দুর্বল ঈমানের অধিকারী মুসলমানদের জন্যও প্রযোজ্য?
হানাফী মতে ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানদের অবস্থা দুর্বল ছিল বিধায় শরীয়তে এ হুকুম দেয়া হয় কিন্তু এখন ইসলাম শক্তিশালী হয়েছে। অতএব,কারণ বিলুপ্ত হওয়ায় হুকুমও বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু অন্য চার মাজহাব কয়েক ধরনের “মুআল্লাফাহ্” নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। আর এসব আলোচনার উপসংহার হচ্ছে একটি,তা হচ্ছে,হুকুমটি বহাল আছে,মানসুখ হয় নি এবং মুআল্লাফাতু কুলুবিহিম অংশের যাকাত মুসলিম‑অমুসলিম উভয়কেই দেয়া যাবে,তবে শর্ত হচ্ছে,এ থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের কল্যাণ হাসিল হবে। কারণ হযরত রাসূল (সা.) ছাফওয়ান বিন উমাইয়্যাকে যাকাত দিয়েছিলেন যদিও সে ছিল মুশরিক। একইভাবে তিনি আবু সুফিয়ান ও তার মত অন্য লোকদেরকে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়ার পর যাকাত দিয়েছিলেন। ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধন থেকে বিরত রাখা এবং ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে তাদের বন্ধনকে মজবুত করার লক্ষেই তিনি তাদেরকে যাকাত দিয়েছিলেন।
৫. ক্রীতদাসের জন্য:-ক্রীতদাসের যাকাত দেয়ার অর্থ হচ্ছে মুক্তিমূল্য দিয়ে ক্রীতদাসকে ক্রয় করে মুক্ত করে দেয়া। এ ব্যাপারে বহু সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে,ইসলাম ক্রীতদাসদের মুক্তির জন্য বিভিন্ন পন্থা তৈরি করেছে। সে যা হোক,আমাদের এ যুগে এ হুকুমটি কার্যকরী করার কোন ক্ষেত্র অবশিষ্ট নেই।
৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিগণ:-এখানে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি বলতে তাদেরকে বোঝানো হয়েছে যারা কোন পাপ কাজে ব্যয় করার উদ্দেশ্য ছাড়াই ঋণ করেছে এবং তা পরিশোধ করতে পারছে না। তাদেরকে ঋণমুক্ত করার জন্য যাকাত দিতে হবে। এ ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে।
৭. সাবিলিল্লাহ্:-সাবিলিল্লাহ্ বা আল্লাহর পথ সম্বন্ধে আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের মত হচ্ছে,এতে ইসলামের প্রতিরক্ষার জন্য যুদ্ধরত মুজাহিদদেরকে বোঝানো হয়েছে।
কিন্তু ইমামীদের মত হচ্ছে,সাবিলিল্লাহ্ কথাটি সাধারণ ও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে,এতে যুদ্ধসহ মসজিদ,হাসপাতাল ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও সর্বসাধারণের জন্য কল্যাণকর সব কিছু শামিল রয়েছে।
৮. ইবনুস্ সাবিল (পথিক):-“ইবনুস সাবিল” বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে যে বিদেশ‑বিভুঁইয়ে রয়েছে এবং স্বীয় ধন-সম্পদ ও জনপদের সাথে তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এমতাবস্থায় তাকে ঐ পরিমাণ যাকাত দেয়া জায়েয যাতে সে তার দেশে পৌঁছতে পারে।

কয়েকটি শাখা বিধান (فروع):
এক : সকল মাজহাবের অভিন্ন মত বনি হাশিমের (হাশিম বংশের লোকদের) জন্য বনি হাশিম বহির্ভূত লোকদের সব ধরনের যাকাত হারাম। তবে তাদের নিজেদের মধ্যে একজনের যাকাত অন্যজনের জন্য হালাল।
দুই : একজন মিসকিনকে পুরো যাকাত প্রদান করা কি জায়েয?
এ প্রশ্নের জবাবে ইমামিগণ বলেন, জায়েয আছে, এমন কি যদি এর ফলে সে ধনীতে পরিণতও হয়ে যায়। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, তাকে একবারে তা দিতে হবে, বার বার নয়।
হানাফী ও হাম্বলিগণ বলেন, এক ব্যক্তিকে দেয়া জায়েয, তবে শর্ত হচ্ছে, এমন পরিমাণ দেয়া যাবে না যাতে সে ধনী হয়ে যায়।
মালিকীদের মতে এক ব্যক্তিকে পুরো যাকাত দেয়া যাবে, তবে যাকাত আদায়কারীকে নয়। কারণ তার জন্য তার কাজের পারিশ্রমিকের বেশি নেয়া জায়েয নয়।
শাফেয়ীদের মতে আট শ্রেণীর লোকদের জন্যই যাকাত বণ্টন করা ওয়াজিব হবে যদি সব শ্রেণীর লোকই পাওয়া যায়। যদি সব শ্রেণীর লোক পাওয়া না যায় তাহলে যে সব শ্রেণীর লোক পাওয়া যায় তাদের মধ্যেই যাকাত বণ্টন করতে হবে। আর প্রতিটি শ্রেণী থেকে কমপক্ষে তিন জনকে দিতে হবে।
তিন : যাকাতযোগ্য মাল দুই ভাগে বিভক্ত।
প্রথম ভাগ হচ্ছে সেসব সম্পদ যার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবার জন্য মালিকের কাছে এক বছর থাকা জরুরী। অতএব,বছর পূর্ণ হবার পূর্বে তাতে যাকাত বর্তাবে না। পশু সম্পদ ও ব্যবসায়ের পুঁজি এ ভাগের অন্তর্ভুক্ত। ইমামীদের মতে যাকাতযোগ্য সম্পদ মালিকের হাতে এগার মাস অতিক্রান্ত হয়ে দ্বাদশ মাসে প্রবেশ করতে হবে।
দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে সেসব মাল যা পুরো এক বছর হাতে থাকা শর্ত নয়। যেমন ফলমূল ও খাদ্যশস্য। এসব বস্তুর যাকাত তা পুষ্ট হবার সাথে সাথেই ওয়াজিব হয়। তবে সর্বসম্মত মত হচ্ছে,ফলমূলের যাকাত (অবস্থা ভেদে) তা গাছ থেকে পাড়া,রোদে দেয়া ও শুকানোর সময় আলাদা করতে হবে ও হকদারদের দিতে হবে এবং খাদ্যশস্যের যাকাত খাদ্যশস্য কাটা ও খড় থেকে দানা পৃথক (মাড়াই) করার সময় দিতে হবে। সময় থাকা ও প্রদান করা সম্ভব হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি যাকাত প্রদানে বিলম্ব করবে সে গুনাহগার হবে এবং এজন্য তাকে দায়িত্ব বহন করতে হবে। কারণ সে স্বেচ্ছায় ওয়াজিব প্রদানে যথাসময় থেকে বিলম্ব করেছে এবং বিলম্ব করে তা সময়ের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছে।

পাদটীকা:-
১. ফকীহ্গণ বাধ্যতামূলক কাজ বোঝাতে সাধারণত ‘ওয়াজিব’ শব্দ ব্যবহার করেছেন যদিও আমাদের দেশে এজন্য ‘ফরয’ শব্দের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। এখানে গ্রন্থকার ‘ওয়াজিব’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। তাই অনুবাদেও ‘ওয়াজিব’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে এজন্য ‘দিতে হবে’ ‘করতে হবে’ ইত্যাদি আবশ্যিকতা নির্দেশক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ সকল ক্ষেত্রেই ‘ফরয/ওয়াজিব’ বুঝতে হবে।- অনুবাদক।
২. অবশ্য হানাফী মাজহাবের মতে কৃষিজাত দ্রব্য ও ফলমূলের যাকাতের ক্ষেত্রে মালিক বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন অথবা বালেগ কিনা তা বিবেচ্য নয় অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে যাকাত দিতেই হবে।
৩. হানাফী মাজহাবের মতে দুই নিসাবের মধ্যবর্তী সংখ্যার জন্য যাকাত মওকুফ করা হয়েছে,তবে চল্লিশ ও ষাটের মধ্যবর্তী সংখ্যার জন্য তা প্রযোজ্য নয়। চল্লিশের অতিরিক্ত প্রতি একটির জন্য একটি পূর্ণ বয়স্ক গরু/মহিষের শতকরা আড়াই ভাগ ও দু’টির জন্য একটি পূর্ণ বয়স্ক গরু/মহিষের শতকরা পাঁচ ভাগ হারে হিসাব করে যাকাত দিতে হবে।
(الفقه على المذاهب الأربعة,باب الزكاة)
৪. বিশ মিসকাল ৯৩.৭৫ গ্রামের সমান। (فرهنك عميد- এ প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে কৃত হিসাব- অনুবাদক)
৫. ২০০ দিরহাম ১৫৬.২৫ গ্রামের সমান। (فرهنك عميد- এ প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে কৃত হিসাব- অনুবাদক)
৬. এখানে প্রবাহের ফলে নিজে নিজেই সিঞ্চিত হওয়া বুঝিয়েছে যাতে মালিককে কোন শ্রম বা অর্থ ব্যয় করতে হয় না। তাই এসব উৎসের পানি পাম্প দ্বারা তুলে জমিতে সেচ করা হলেও তা এর মধ্যে পড়বে না,বরং পরবর্তী পর্যায়ের মধ্যে পড়বে যাতে শতকরা ৫ ভাগ যাকাত দিতে হয়।- অনুবাদক।
৭. ছা-এর পরিমাণ হচ্ছে ৪ মুদ্দ (مد) কিন্তু মুদ্দ‑এর পরিমাণ নিয়ে বিতর্ক আছে। গ্রন্থকার তাঁর গ্রন্থে (পৃঃ ১৫০) মুদ্দ‑এর পরিমাণ লিখেছেন ৮০০ গ্রাম। সে হিসেবে পাঁচ ওয়াসকের পরিমাণ ৯৬০ কিলোগ্রাম। কিন্তু فرهنك عميد‑এ এর পরিমাণ উল্লিখিত আছে ৭৫০ গ্রাম। সে হিসেবে ৫ ওয়াস্কের পরিমাণ হয় ৯০০ কিলোগ্রাম।- অনুবাদক।
৮. এ থেকে বোঝা যাচ্ছে,দোকানের সেলামী বাবদ প্রদত্ত অর্থ ও আসবাবপত্রের মূল্য যাকাতযোগ্য পুঁজি হিসেবে গণ্য হবে না।- অনুবাদক।
[الفقه على المذاهب الخمسة গ্রন্থ থেকে অনুদিত । জ্যোতি,১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা।]

মন্তব্য

  • This arti­cle is fan­tas­tic! The insights pro­vid­ed are very valu­able. For those inter­est­ed in explor­ing more, check out this link: LEARN MORE. Look­ing for­ward to the discussion!

  • hel­lo there and thank you for your infor­ma­tion – I’ve cer­tain­ly picked up any­thing new
    from right here. I did how­ev­er exper­tise sev­er­al tech­ni­cal points using this web­site, as I expe­ri­enced to
    reload the site a lot of times pre­vi­ous to I could get it to load correctly.
    I had been won­der­ing if your web host is OK?
    Not that I’m com­plain­ing, but slug­gish load­ing instances times will some­times affect your place­ment in google and could dam­age your high-qual­i­ty score if ads and mar­ket­ing with
    Adwords. Any­way I’m adding this RSS to my email and could look out for much more of your respec­tive excit­ing content.
    Make sure you update this again very soon.. Najlep­sze escape roomy

  • I think this is one of the most sig­nif­i­cant info for me.
    And i’m glad read­ing your arti­cle. But want to remark on few gen­er­al things, The web­site style is per­fect, the arti­cles is real­ly nice :
    D. Good job, cheers

  • Hel­lo there! I just wish to give you a big thumbs up for your excel­lent info you’ve got here on this post. I am com­ing back to your web­site for more soon.

  • Good post. I learn some­thing new and chal­leng­ing on blogs I stum­ble­upon on a dai­ly basis. It will always be inter­est­ing to read con­tent from oth­er writ­ers and use some­thing from their sites.

  • I’m impressed, I must say. Rarely do I come across a blog that’s both equal­ly educa­tive and enter­tain­ing, and with­out a doubt, you’ve hit the nail on the head. The issue is some­thing which not enough men and women are speak­ing intel­li­gent­ly about. I’m very hap­py that I came across this in my search for some­thing relat­ing to this.

  • I blog often and I seri­ous­ly thank you for your infor­ma­tion. This great arti­cle has real­ly peaked my inter­est. I’m going to take a note of your web­site and keep check­ing for new infor­ma­tion about once a week. I sub­scribed to your Feed as well.

  • Oh my good­ness! Impres­sive arti­cle dude! Thanks, How­ev­er I am hav­ing prob­lems with your RSS. I don’t know the rea­son why I am unable to sub­scribe to it. Is there any­body else get­ting iden­ti­cal RSS issues? Any­body who knows the solu­tion can you kind­ly respond? Thanks.

  • I want to to thank you for this good read!! I cer­tain­ly enjoyed every bit of it. I’ve got you saved as a favorite to look at new things you post…

  • Greet­ings! Very use­ful advice with­in this arti­cle! It’s the lit­tle changes that pro­duce the biggest changes. Many thanks for sharing!

  • Hi, There’s no doubt that your blog could be hav­ing brows­er com­pat­i­bil­i­ty prob­lems. When I take a look at your web­site in Safari, it looks fine how­ev­er when open­ing in IE, it’s got some over­lap­ping issues. I just want­ed to pro­vide you with a quick heads up! Besides that, fan­tas­tic website.

  • Good post. I learn some­thing total­ly new and chal­leng­ing on web­sites I stum­ble­upon every day. It’s always use­ful to read through arti­cles from oth­er authors and use some­thing from their websites.

  • An impres­sive share! I have just for­ward­ed this onto a friend who was doing a lit­tle home­work on this. And he actu­al­ly bought me din­ner sim­ply because I found it for him… lol. So let me reword this.… Thank YOU for the meal!! But yeah, thanks for spend­ing time to dis­cuss this mat­ter here on your site.

  • Greet­ings! Very use­ful advice with­in this arti­cle! It is the lit­tle changes that pro­duce the great­est changes. Thanks a lot for sharing!

  • Good post. I learn some­thing total­ly new and chal­leng­ing on web­sites I stum­ble­upon every day. It’s always use­ful to read arti­cles from oth­er authors and prac­tice some­thing from oth­er websites.

মতামত দিন