“আমার প্রথম ইরাক সফর।”-আলোচ্য প্রবন্ধটি কাদেরিয়া তরিকার এক সময়ের একনিষ্ঠ ভক্ত আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ার বাসিন্দা ও তিউনিসিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক জনাব ডঃ মুহাম্মদ তিজানী আল সামাভীর ভ্রমণ কাহিনীর উপর ব্যাপক সমাদৃত গবেষণামূলক বই “Then I was guided”(যা বিশ্বের অনেক দেশে, অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে) থেকে নেওয়া হয়েছে।বাংলাদেশে এই বইটি “অবশেষে আমি সত্যপথের সন্ধান পেলাম” শিরোনামে বাংলাতে অনূদিত হয়েছে।
নাজাফের বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানির ইয়ারকন্ডিশন এক লম্বা বাসে চড়ে আমরা দামেস্ক থেকে বাগদাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছি। যখন বাগদাদ গেলাম তখন দিনের উষ্ণতা চল্লিশ ডিগ্রি। বাস থেকে নেমেই আমরা অত্যাধিক সুন্দর ছিমছাম একটি মহল্লা, যেখানে আমার বন্ধুর বাসা, সেদিকে রওয়ানা দিলাম। পুরা বাসা ইয়ারকন্ডিশন, তাই সেখানে পৌছে প্রশান্তি অনুভব করলাম। বন্ধুটি বাসার ভিতর থেকে কাপড় বদলানাের জন্য একধরণের ঢিলাঢালা লম্বা জামা নিয়ে আসলেন- যাকে তাদের ভাষায় দশদাশ বলা হয়।
দস্তরখানায় বিভিন্ন প্রকারের ফলমূলসহ খাবার দেওয়া হয়েছে। তার স্ত্রী হেজাব পরে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে সালাম দিলেন। তার পিতা একজন আলেম, তিনি আমার সাথে এমন ভাবে মুসাফা করলেন যাতে মনে হলাে অনেক দিনের পরিচিত আমরা। অর্থাৎ তার পিতা কাল আবা উড়িয়ে দরজায় দাড়িয়ে আমাদের সালাম দিলেন, মারহাবা বলে শুভাগমন জানালেন। মা না আসায় আমার দোস্ত দুঃখ প্রকাশ করে বললেন- আমাদের এখানে মেয়েদের সাথে মুসাফাহ বৈধ নয়: বিধায় আম্মার ব্যাপারে আমরা দুঃখিত। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম যে, যাদের আমরা দ্বীনের বাইরে মনে করি অথচ তারাই প্রকৃত দ্বীনের চর্চা করছে। আর সফরের প্রথম দিনেই আমার বন্ধুর উচ্চতর ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মানবােধ, প্রাঞ্জল সহমর্মিতা ও মানবিকতা দেখে আমার অনুভব হলাে- আমি বােধ হয় মেহমান নই বরং তাদেরই অতি আপনজন। রাতে সবাই ছাদের উপর শুতে গেলাম, সেখানে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বিছানা পাতা আছে। আমি অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাইনি, শুধু ভাবছি।বাস্তবেই আমি না স্বপ্নে? আসলেই কি আমি সাইয়্যেদ আবদুল কাদের জিলানীর শহরে এসেছি?
বিরবির করে আওড়ানাে আমার কথা শুনে বন্ধু মুচকি হেসে বললেনঃ তিউনিসবাসীরা আঃ কাদের জিলানীর ব্যাপারে কি বলেন? বাস‑আর কি, মুহতারামের সস্ত কেরামতি-গুণাবলী যা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে, একে একে সব তার কাছে বললাম এবং বললাম তিনি হলেন আউলিয়াদের কুতুব, যেমন-নবী (সাঃ) সমস্ত নবীগণের সর্দার। এভাবেই তিনি আবার সমস্ত আওলিয়াদের সর্দার, যার পদ মুবারক সকল অলী আওলিয়াদের কাঁধের উপর রক্ষিত। তিনি বলতেন, মানুষ কাবার তাওয়াফ করে সাত বার আর আমি কাবা তাওয়াফ করি আমার তাবু সহকারে।
এ সব কথা বলে আমি আমার বন্ধুকে বুঝাতে চেয়েছি, যে জনাব শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) তার কতিপয় একান্ত মুরিদ ও তার প্রত্যাশিত ব্যক্তির কাছে সশরীরে উপস্থিত হন, তাদের অসুস্থতা আরােগ্য, করান এবং বিপদের প্রতিবিধান করেন। কথাগুলাে বলার সময় আমি ওয়াহাবী বিশ্বাস যা দ্বারা আমি খুব প্রভাবিত ছিলাম, ভুলে যাই বা ভুলে যেতে বাধ্য হই। যে এসব কথা মুলতঃ শিরক। আমি যখন বুঝলাম আমার দোস্তের এ সব কথায় আগ্রহ নেই, তখন বললামঃ- “কি ভাই আপনারা কি বিশ্বাসী নন? এগুলাে কি সঠিক নয়- আপনার কি অভিমত”। দোস্ত আমার হেসে দিয়ে বললেনঃ “ভ্রমণে ক্লান্ত হয়ে পড়েছযাও এখন শুয়ে পড়গে। আগামী কাল আল্লাহ চাহেতাে আঃ কাদের জিলানীর (রহঃ) মাজার জিয়ারাতে যাব”। একথা শুনে আমার মন যারপর নাই খুশিতে তােলপাড় করতে থাকলাে। আর মনে হতে লাগলাে ইস এখন যদি সকাল হয়ে যেত। অতঃপর শুয়ে পড়লাম। বেলা না উঠা পর্যন্ত ঘুম ভাঙল না। ফজরের নামাজ পর্যন্ত কাযা হয়ে গেল। বন্ধু বললেন, আমাকে বেশ কয়বার নিষ্ফল জাগানাের চেষ্টা করেছেন আমি আরাম করি তাই আর বিরক্ত করেন নি।
জনাব আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) ও হযরত ইমাম মুসা কাজেম (আঃ)ঃ
নাস্তা করেই আমরা’ (বাবুশ শায়খ) জিলানীর মাজার এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আর আমার চোখ যখনই সেই বরকতময় স্থান দেখলাে- যা দেখার জন্য মন আনচান করছিল, তখনই আমি দৌড়ে বেহুশের মত ভিতরে প্রবেশ করলাম যে, তার কোলে আমাকে সােপর্দ করবাে- মাজারের যেদিকেই আমি যাচ্ছি আমার দোস্ত ছায়ার মত আমাকে অনুসরণ করছে। শেষে সেখানে পৌছলাম, যেখানে জিয়ারতকারীগণ, সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়ার মত ঝাপিয়ে পড়ছে। দেখলাম বায়তুল্লাহর তাওয়াফের মত মানুষ ঘুরছে। অনেকে মিষ্টি নিক্ষেপ করছে আর তা উঠিয়ে খাওয়ার জন্য মানুষ পাল্লা দিয়ে প্রতিযােগিতা করছে। আমি দৌড়ে যেয়ে দুই টুকরা উঠালাম। বরকতের জন্য একটুকরা সেখানেই খেয়ে ফেললাম, আরেক টুকরা শুভাকাঙ্খিদের দেওয়ার জন্য পকেটে রাখলাম, সেখানেই নামাজ পড়লাম, অনেক অনেক দোয়া করলাম। পানি পান করলাম যেমন জমজমের পানিয়ের মত।বন্ধুকে বললাম- আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি একটা খাম কিনে আমার দেশের বন্ধুর কাছে একটা চিঠি লিখি, যে খামের উপর শায়খ আব্দুল কাদের জিলানীর (রহঃ) এর ফটো আছে। যাতে বন্ধুদের আত্মীয়দের কাছে বলতে পারি যে, দেখ যেখানে কেও যাওনি সেখানেই আমার বন্ধু আমাকে নিয়ে গেছে।
একটু সময় পেয়ে এক হােটেলে দুপুরের খাবার খেলাম। হােটেলটি যতদুর মনে হয় বাগদাদের মাঝখানে। অতঃপর বন্ধু ভাড়ায় টেক্সি নিলেন এবং আমরা কাজমীন পৌছলাম। কাজমীন যে আমরা যাব তা তখনই বুঝেছিলাম, যখন তিনি টেক্সি ড্রাইভারের সাথে কথা বলার সময় শব্দটির উচ্চারণ বারবার করছিলেন। কাজমীনে আমরা টেক্সি থেকে নামলাম- কিছু দূর হেঁটে চলছি নারী-পুরুষ শিশু-কিশোের আবালবৃদ্ধ বনিতার কনভয় এগিয়ে চলছে। আমরাও সে দিকেই যাচ্ছি। জনতার হাতে কাঁধে কিছু আসবাব পত্রও আছে, যে দৃশ্য দেখে আমার হজ্জ্বের কথা মনে হলাে। এখনও লক্ষ্য স্থানে যেতে পারিনি। এমন সময় স্বর্ণ দ্বারা মুড়ান কিছু পিলার ও মিনার দেখতে পেলাম, যা চোখকে ঝলসে দিল।আমার বুঝতে বাকী রইলাে না যে এটা শিয়াদের মসজিদ। কারণ এরা মসজিদকে স্বর্ণরৌপ্য স্তরে মুড়িয়ে দেয় যা ইসলামে হারাম। এটা মনে হতেই মন চাইল আমি যেতে অস্বীকার করি। কিন্তু বন্ধুর মনের দিকে লক্ষ্য করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সঙ্গে চললাম। প্রথম দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখলাম শ্বেতশুভ্র শশু মন্ডিত কিছু বয়বৃদ্ধলােক দরজা মুছছেন আর চুমা দিচ্ছেন, কিন্তু যথেষ্ট বড় একটা সাইন বাের্ড দেখে আমার একটু শান্তি লাগলাে। যাতে লেখা ছিল বেপর্দা মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। এবং সাথেই ইমাম আলী (আঃ) এর একটি হাদীস লিখা রয়েছে- “এমন সময় আসবে যখন নারীগণ উলঙ্গপ্রায় পােষাক পরবে.….।” দেখতে দেখতে দরজার স্থানে এসে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, দরজাগুলাে স্বর্ণ দ্বারা মুড়ানাে এবং সুন্দর করে কোরানের আয়াত খােদাই করা। সেখানে আমার বন্ধু প্রবেশের দোয়া পাঠ করলেন।দোয়া দরুদ পড়ে বন্ধু যখন ভিতরে ঢুকলেন আমিও তার পিছে পিছে চললাম। আর আমার মনে হতে লাগলাে সেই সব কিতাবের লিখনগুলাে যাতে শিয়াদের কাফের বলা হয়েছে। ভিতরে যেয়ে আমি যে অবস্থা দেখলাম তা ভাষায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আর আমি যেহেতু অনভিজ্ঞ ও অপরিচিত তাই ভেবাচেকা খাওয়ারই কথা। সময় সময় এদিক সেদিক চেয়ে জিয়ারতকারীদের দেখছি। যারা জিয়ারত করছে, কেঁদে কেঁদে বেহুশ হচ্ছে, চুমু দিচ্ছে। আবার অনেকে নামাজও আদায় করছে। তখন আমার হুজুরের (সাঃ) সেই হাদীস মনে পড়ল যেখানে তিনি বলেন- “খােদার লানত ইহুদী ও নাসরাদের উপর কারণ তারা তাদের ওলিদের কবরগুলােকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে”।
আমি আমার বন্ধু থেকেও অনেক দুরে পড়ে গেছি, যিনি ভিতরে ঢুকেই কাঁদতে থাকেন। আমি তাকে নামাজ পড়তে দেখে সেই খুটিটার পাশে গেলাম। যেখানে জিয়ারত সম্পর্কিত বিষয়াবলি লেখা। আমি এগুলাে পড়ছি। আশ্চর্যের বিষয় তাতে এমন বড় বুজুর্গের নাম লিখা যার কথা জীবনেও শুনিনি। যে জন্য অনেক কিছুই আমি বুঝতে পারলাম না। আমি এককোনে দাড়িয়ে ফাতেহা পড়ে দোয়া করলাম। হে খােদা! যদি এই কবরবাসী মুসলমান হয়, তাহলে তাকে মাফ করাে- তুমিত সবকিছুর নিপুন তত্ত্ব জান।এ সময় আমার বন্ধু কাছে এসে কানে কানে বললাে, যদি তােমার কোন সমস্যা থাকে তাহলে এখানে খােদাকে বল সমাধা হয়ে। যাবে। আমরা এটাকে “বাবুল হাওয়ায়েজ” (সমস্যা সমুহের দরজা) বলি। কথাটা আমি শুনেও না শুনার ভান করলাম, আল্লাহ মাফ করুন। দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমি সেই সব শ্বেত শুভ্র স্ম মন্ডিত মাথায় কাল সাদা পাগড়ী বাধা লম্বা লম্বা দাড়ি কপালে সেজদার চিহ্ন, গা থেকে ঘ্রাণ আসছিল এমন বৃদ্ধদের দেখছিলাম। বৃদ্ধগুলিকে দেখছি যারা প্রবেশ করছে আর দাড়ি টেনে টেনে ছিড়ছে- বুক চাপরে কান্নার রােল ফেলে দিয়েছে। এসব দৃশ্য আমার মন ও মস্তিস্ককে ভাবিয়ে তুললাে। যে সত্যিই কি এদের চোখের পানি সম্পূর্ণই মিথ্যে, বৃথা? এই বুড়াে লােকগুলি কি বিভ্রান্তিতে আছে? এগুলাে ভাবতে ভাবতে অস্থির চিত্তে বেরুলাম। তখন আমার বন্ধুও সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখিয়ে , মাজারের দিকে মুখ রেখে পিছিয়ে পিছিয়ে বেরুলেন যাতে কবরবাসীর কোন বেয়াদবী না হয়।
আমি বললামঃ “এটা কার মাজার”?
বন্ধঃ “ইমাম মুসা কাজেম (আঃ) ”।
আমিঃ “এই ইমাম মুসা কাজেম (আঃ) আবার কে”?
বন্ধুঃ “সুবহানআল্লাহ! তােমরা আহলে সুন্নাত জ্ঞানের পথ ছেড়ে দিয়ে গড্ডালিকাকে গ্রহন করেছ”।
আমি রাগতস্বরে বললামঃ “আপনি একি বলছেন যে, আমরা জ্ঞান বুদ্ধির পথ ছেড়ে দিয়ে বাকলকে ধারণ করেছি”?
মতামত দিন