আল্লাহ বলিয়াছেনঃ ‘ইহুদি মুশরিক তোমাদের বুনিয়াদি দুশমন’-সেই কারনে আল্লাহ্র কালাম আল্লাহ্র মুখের উপর ছুঁড়িয়া মারিয়া মুসলমানেরা নানা গলি ঘিঞ্জি দিয়া ঢুকিয়া ইহুদি-ইহুদিনী ও মুশরিকার পদ লেহন করিতেছে।হযরত উমর যে অর্থনীতি প্রবর্তন করিয়াছিলেন যাহাকে অনেকে হযরত রসূলের চাইতেও অধিকতর কার্যকরী ভাবিয়া অনেক কিতাবে লিখিয়া আসিতেছিল,সে-ব্যবস্থা আধুনিক অর্থনৈতিক সংকট দূর করিতে অক্ষম হইয়াছে। মনে হয়, হযরত উমরের কালেও তেমন দূর করিতে পারে নাই।পারিলে হজরত উমরের রাজত্ব খতম হইবার দুই বছর আগেই আরবে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ লাগিবে কেন ? হযরত উসমানের কালের বিদ্রোহে তো মূলত পূর্বে তাঁহার সুদীর্ঘ ৭ বছরের অর্থনৈতিক পরিচালনার (আবু বকরের দুই বছরও তাহার প্রভাবই ছিল) পরিণতিতেই দুর্ভিক্ষ এবং স্বজনপ্রীতির পরিনতিতে বেসামাল অর্থনৈতিক অসাম্য ও দুরবস্থার ফলে পুনরায় উমর-আমলীয় সেইরূপ দুর্ভিক্ষের মতো অভাবের ভয়েই লোকে ক্ষিপ্ত হইয়াছিল।খুঁজিয়া দেখিলাম, হজরত রসূলের ধর্মীয় বিপ্লব যে অর্থনৈতিক বিপ্লবের বুনিয়াদে মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল,তাঁহার ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে বহু কারসাজি ও গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল‑মারফত আসলে কৌশলে তাহা উল্টাইয়া ফেলাই লক্ষ্য ছিল।
পাকিস্তান হওয়াতে একেবারে পোয়াবারো অবস্থা হইয়া গিয়াছিল।করাচি উর্দু কলেজের ইসলামিয়াতের অধ্যাপক কমরুদ্দীন খাঁ প্রমুখ নানা প্রসঙ্গে পরোক্ষভাবে প্রকাশ করিয়াই ফেলিলেন যে, আল্লাহ‑রসুল ও আল্লাহ‑রসূলের মনোনীত সর্বাত্মক পবিত্রতায় পবিত্রিত {সুরাহ আহযাবঃ ৩৩ (শেষভাগ) ইহাই আয়াত‑ই-তাৎহিরা} উলিল আমর শাসকগণ আধুনিক বিশ্বের পলিটিক্স ক্ষেত্রে অচল; সেইভাবে তিনি লিখিয়া ফেলিলেন প্রবন্ধ “ইসলাম ও উমাইয়া রাস্ট্রনীতি”।তাহাতে প্রমান করিতে চাহিলেন, যে উমাইয়া শাসকদিগকে লোকে খারাপ বলিলে কি হইবে, আসলে তাহারা খারাপ তো নয়ই, বরং আল্লাহ‑রসুল ও রসূলের আহলি-বায়েত এত করিয়াও যে পলিটিক্স দান করিতে পারেন নাই বরং পলিটিক্সের উল্টা করিয়াছেন, উমাইয়ারা বরং সেই পলিটিক্স দান করিয়া দুনিয়াতে মুসলিম জাতির মুখরক্ষা করিয়াছেন।সে জন্যে ‘হুজুর’ পলিটিসিয়ানেরা গোপনে মুয়াবিয়া-ইয়াজিদের জন্মদিন পালন মারফত তাহাদের প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করিতেছে।অথচ ইয়াজিদ স্বয়ং দামেশকে হজরত ইমাম হুসায়নের কাটা-মাথা দেখাইয়া হজরত জয়নব বিনতে আলী ( হুসায়ন ভগ্নী ) কে বলিয়াছিলঃ “দ্যাখো, জয়নব, তোমার জাদ্দ মুহম্মদ আমার জাদ্দ আবু সুফিয়ান হইতে শ্রেষ্ঠতর ঠিকই, কিন্তু তোমার ওয়ালিদ আলী আমার ওয়ালিদ মুয়াবিয়ার চাইতে শ্রেষ্ঠতর নয়, আর তোমার এই ভাই হুসায়নও আমার চাইতে শ্রেষ্ঠতর নয়।” সেই হইতেই ‘সাল্লাল্লাহু আলা মুহাম্মদ’ এই আবতারী দুরুদ ইয়াজিদ বংশীয় আরবী বিদ্বানেরা প্রবর্তন করিয়াছে।ইয়াজিদও যে-স্থলে (অবশ্য রসুল‑প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য লোভে গিরেফতার হইয়াই) হজরত রসূলের কৃতিত্বকে অস্বীকার করিতে পারে নাই, ইসলামিয়াতের অধ্যাপক তাহাও করিয়াছে।
কাজেই,১৯৭১ সনে এখানে যখন মুসলমানে মুসলমানে আল্লাহর দিকে না চাহিয়া নিজেদের বিভিন্নমুখী স্বার্থ লইয়া মারামারিতে মশগুল,মুখে উভয়েরই ইসলামের নাম,তখন ১৯৪২ সন হইতে আমার হাতে যে-সকল মাল‑মসলা জোগাড় হইয়াছিল,তাহা দিয়া ইসলামিয়াতের অধ্যাপকের ‘ইসলাম ও উমাইয়া রাষ্ট্রনীতি’ প্রবন্ধের সম্যক বিশ্লেষণে বসিয়া গিয়াছিলাম (জুলাই ১৯৭১)।অবশ্য কোনো কোনো স্থলে পরেও কিছু সংযোজন করিয়াছি।কারন এই যে, মাঝে মাঝেই মুসলমানে মুসলমানে মারামারির মূল কারন বাহির করিতে হইতেছে । এক অন্ধকার ঘরে দুই নারীর একজনের এক ছেলে হইয়াছে, অপরের এক মেয়ে হইয়াছে।কিন্তু জাহিলীয়া জমানার কুসংস্কারবশে ছেলেটিকে উভয়েই নিজ সন্তান বলিয়া দাবি করিতেছে।হজরত উমরের কাছে তাহার বিচার আসিয়াছে (হজরত উমর তখন খলিফা)।উমর দিশেহারা হইয়া আলী যেখানে এক ইহুদির বাগানে দিন‑মজুর নিযুক্ত ছিলেন সেখানে উপস্থিত।বলিলেনঃ ‘শীঘ্র আস,মহা সংকট।
হযরত আলী বলিলেনঃ “আমি আসিতে পারিব না।ইহুদির সঙ্গে সারাদিন কাজ করার বিনিময়ে নির্দিষ্ট পরিমান মজুরি পাওয়ার শর্তে আমি আবদ্ধ। তুমি ওখান হইতেই বল,আমি এই কুয়ার পানি তুলিতে তুলিতে তোমার সমস্যার সমাধান দিব।” উমর তখন ঘটনা বলিলেন।
হজরত আলী বলিলেনঃ “তোমরা আল কোরআন পড় নাই ?”
উমর বলিলেনঃ “এই হইতেছে আজিকার ঘটনা। কোরআনে ইহার কথা থাকিতে যাইবে কেন ?”
হজরত উমরের কথা হইতে যেমন বুঝা যায়,কোরআন কে সকল সমস্যার সমাধানগ্রন্থ বলিয়া তাহারা মনে করিতেন না, শুধু নবীজীর আহলি-বায়তের লোকেরাও তাঁহাদের অনুসারীরাই মাত্র মনে করিতেন,সেটা বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়াছে।কমরুদ্দীন খাঁর মতো ইসলামিয়াতের অধ্যাপকেরা সেজন্যই বলেন, ‘কোরআন ও হাদিসে এমন কোনো শাসন প্রণালীর উল্লেখ নাই ইত্যাদি।’
হজরত আলী উমরকে বলিলেনঃ “আছে আছে।সমান দুই শিশিতে দুই মায়ের দুধ ভরিয়া ওজন করিলে যাহার দুধ বেশি ভারি হইবে,সেই মা ছেলে পাইবে।কারন আল্লাহ বলিয়াছেন, মেয়ের চাইতে ছেলের খোরাক বেশি।”
কিন্তু হজরত উমরও যেমন তেমনি যেসব ইসলামিয়াতের অধ্যাপক তাহারা বানাইয়া ছাড়িয়া দিয়াছেন, কোরআনকে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে তাহারাও দেখে নাই।
অবশ্য উমর বলিয়াছেনঃ “আলী না থাকলে উমর ধ্বংস হইয়া যাইত।” ইবনে তাইমিয়ার যে কথা খাঁ সাহেব দিয়াছেন সে আরো মজাদার।
অধ্যাপক মুফাখখারুল ইসলামের রচিত গবেষণামূলক গ্রন্থ “ইতিহাসগত বিভ্রান্তির রহস্য ” থেকে সংগৃহীত।
সিপাহসালার | ইনস্টিটিউশন | সেপ্টেম্বর ২০২০| এস এইচ হক
মতামত দিন