[তাবাস মরুভূমিতে মার্কিন ব্যর্থ অভিযান নিয়ে গল্প।১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পর তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাসের ৫২ জন কর্মীকে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে আটক করা হয়। আটক কর্মীদের উদ্ধারের জন্য পারস্য উপসাগর থেকে একটি অভিযান চালায় আমেরিকা।১৯৮০ সালের ২৫ এপ্রিল পরিচালিত এ অভিযানের নাম দেয়া হয়েছিল ‘অপারেশন ঈগল ক্ল’। রাতের আঁধারে চালানো ওই অভিযান ধূলিঝড়ের কবলে পড়ে এবং বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টার, গানশিপ ও জঙ্গিবিমান ধ্বংস হয়। একইসঙ্গে নিহত হয় আট মার্কিন সেনা। পরে এ অভিযান বাতিল করতে বাধ্য হয় মার্কিন বাহিনী।ব্যর্থ এ অভিযানের আগে ও পরের ঘটনাগুলো নিয়ে চমৎকার একটি গল্প লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রুশিয়া জামান রত্না.।]

: ওহ! হুম, কিসিঞ্জার বলো। এ অসময়ে তোমার ফোন জরুরি কিছু?
: ইয়েস, মি. প্রেসিডেন্ট। খুবই জরুরি একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছি তবে সেটা টেলিফোনে নয়। সরাসরি কথা বলতে হবে। সিডিউল পেলে আমি আর ডেভিড রকফেলার আসতে চাচ্ছি। আর যদি সম্ভব হয় তবে সেটা এক্ষুনি ।
মৃদু গলায় বললেন,
: আচ্ছা ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করছি।
ঘন্টাখানেক পর প্রেসিডেন্টের রুমের দরজা ঠেলে ভিতরে ডুকলেন দুই প্রভাবশালী কূটনীতিক, হেনরি আর ডেভিড। অভিবাদন জানিয়ে কোন রকম ভণিতা ছাড়াই হেনরি বলতে শুরু করলেন,
: মি. প্রেসিডেন্ট! রেজা শাহ পাহলভী আমেরিকা আসতে চাইছেন। তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া আমাদের দায়িত্ব। আপনি অনুমতি দিলে খুব দ্রুত তাকে বিশেষ ফ্লাইটে এখানে আনতে চাচ্ছি।
কথাটা শুনে কার্টার আঁতকে উঠলেন। কিছুটা উত্তেজিত গলায় বললেন,
: তোমরা পাগল হয়ে গেছো? পাহলভীকে আশ্রয় দিলে খোমেনি আমাদের ছেড়ে দেবে ভেবেছো? জানো না, তিনি কতটা জেদি মানুষ, ভাঙবে তবু মচকাবে না। ওকে খ্যাপানো মোটেও ঠিক হবে না, বিশেষ করে এখন তো নয়ই। সামনে ইলেকশন। জনগণের সেন্টিমেন্ট নিয়েও তো ভাবতে হবে, নাকি?
: মি. প্রেসিডেন্ট! এত শত বুঝিনা। পাহলভী আমাদের এজেন্ট, বিশ্বস্থ মানুষ, তাকে আশ্রয় দিতেই হবে, না হলে অন্যান্য দেশে যারা আমাদের এজেন্ট আছে তাদের কাছে ভুল বার্তা যাবে। এটা আমরা কিছুতেই হতে দিতে পারিনা। ভুলে যাবেন না, আমি হেনরি কিসিঞ্জার। আমার চেয়ে বেশি কূটনীতি বোঝে এমন মানুষ মার্কিন মুল্লকে পাবেন না।“হুম, তুমি যে কেমন কূটনীতিক তাতো রিচার্ড নিক্সন সাহেব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। ” মনে মনে বললেন কার্টার।তবে, শেষ পর্যন্ত হেনরি আর ডেভিডের চাপের মুখে তিনি নতি স্বীকার করলেন।
: স্যার, আপনার পকেটে ঐ রুমালে কি বেঁধে রেখেছেন?
: ইরানের মাটি!!
পাহলভী ধরা গলায় উত্তর দিলেন। চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। চোখের জল খুব অবাধ্য, ইচ্ছে মতো অস্তিত্বকে জানান দেয়। সময়-অসময় কিচ্ছু বোঝেনা।নিরাপত্তা রক্ষী মৃদু হাসলেন। মনে মনে বললেন, “আপনি মাটি চেয়েছিলেন তাই মাটিই আপনার সঙ্গী হয়েছে। যদি মানুষ চাইতেন, তবে আজ ইরানের জনগণ আপনার সঙ্গী হতো। যে শাসক যা চাইবে, সে তো তাই পাবে। ”
পাহলভীর মার্কিন ভূমিতে পৌঁছানোর খবর বিদ্যুৎবেগে ইরানে পৌঁছে গেল। জনগণ মার্কিনীদের এমন দুঃসাহস দেখে রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়লো। অপেক্ষায় রইলো তাদের রাহবারের নির্দেশনার।সমস্ত ঘটনা ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মূল নেতা আর পরম শ্রদ্ধার ব্যক্তি হযরত আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে ব্রিফ করা হলো। তিনি সব শুনে বললেন‑,
: কার্টার সাহেবকে টেলিফোন করো। আমি কথা বলবো।
এই মানুষটির এই বিশেষ গুণ তার চারপাশের মানুষগুলোকে অবাক করে। যত কঠিন পরিস্থিতিই হোক না কেন, নিজের উত্তেজনা প্রশমিত করে, ধীর স্থির হয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আর তার সবচেয়ে বড় শক্তি নিজের খোদার উপর অগাধ বিশ্বাস।
: অফিসারস!! তোমরা পারবে তো?
: ইয়েস মি. প্রেসিডেন্ট। উই ক্যান ডু ইট।
সবাই একসাথে বলে উঠলো। এমন দৃঢ়তা, বলিষ্ঠতা আর আত্মবিশ্বাস দেখে কার্টার আশ্বস্ত হলেন। কিছুটা হালকা অনুভব করছেন। বললেন,
: ওকে। তোমরা সব ব্যবস্থা করো আমি অনুমতি দিচ্ছি। ঈগলের মত ছোঁ মেরে তেহরান থেকে জিম্মিদের নিয়ে আসবে। এরপর মোল্লাদের বিষয়টা আমি দেখবো। ওরা খুব বেশি দুঃসাহস দেখিয়ে ফেলছে। কিসের ভরসায় ওরা এমন করছে?বলেই তিনি টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন। উদ্দেশ্য একটি টেলিফোন করা, ইরানের প্রসিডেন্ট বনী সদরকে এক্ষুনি ফোন করতে হবে।
: আপনারা সিউর তো যে ঐ অঞ্চলে কোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই?
: প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বলতে কিছু শুকনো বালি আছে।বলেই, পেন্টাগন অফিসার ফিক করে হেসে ফেললেন।
তিনি উর্ধ্বে দুহাত বাড়িয়ে বললেন, “খোদা ইরানকে হেফাজত করুন।”
বাতাসের সেই ফিসফিস শব্দ আরও যেন স্পষ্ট হলো। খোমেনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন কেউ বলছে,-আবাবিল দরে মিয়াদ!! আবাবিল আসছে…!!!
:সর্বানাশ!!! এই সময়ে বালুর ঝড়!
কথাটা শেষ করতে পারলেন না পাইলট। বিকট শব্দে হেভলিক আর বিমান আছড়ে পড়লো মরুভূমির বুকে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। সেই লেলিহান অগ্নিতে পুড়ে ছাই হয়ে গেলে ৮ জন সেনা অফিসার।৯০ মিনিটের মধ্যে বাকি হেলিকপ্টারগুলো এসে পৌছালো তাবাস মরুভূমিতে। সবাই তাকিয়ে দেখল তাদের এত সপ্নের, এত অহংকার আর গৌরবের অপারেশন ঈগল ক্লো আগুনে ঝলসে যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন আর এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ইরানি বাহিনী খবর পেয়ে গেছে। তাই দ্রুত এখান থেকে পালাতে হবে। তিনি টিমের সব সদস্যদের তাড়া দিলেন,
:হারি আপ ডগস। সময় নেই।
এতক্ষণে ক্যাপ্টেনের তাড়া খেয়ে বাকি সদস্যদের ঘোর কাটলো।
:স্যার, দলিলপত্র কি করবো?
একজন সদস্য ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করলো।
এমন পরিস্থিতিতে এ ধরনের নির্বোধ কথা ক্যাপ্টেনের কর্ণ গহ্বরে তীরের মত বিধলো। তিনি চিৎকার করে বললেন,
: জাহান্নামে যাক দলিলপত্র!!। ব্যাটা খোবিশ আগে প্রাণ নিয়ে পালা।
দিনের ঝকঝকে আলো দেখে বোঝার উপায় নেই যে কাল রাতে কি ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সত্য সে তার আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হবেই। আয়াতুল্লাহ খোমেনির মুখে তৃপ্তির হাসি আর বিজয়ী ইরানের জনগণ রাস্তায় নেমে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে রেখেছে সারা ইরান।“মারগ বার অমরিকো, ডেথ টু আমেরিকা”।জিমি কার্টারের প্রেসিডেন্টের চেয়ার সেই স্লোগানে যেন কেঁপে উঠলো, ঠিক ভূমিকম্পের মত।
রুশিয়া জামান রত্না
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১/ ইরান যেমন দেখলাম – ব্রি. জে. ড. এম সাখাওয়াত হোসেন (পালক পাবলিশার্স)।
২/ উইকিপিডিয়া : অপারেশন ঈগল ক্ল।
৩/বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য।
মতামত দিন