প্রবন্ধ

ওঁম (ঔঁ) এবং ( على) আলী (আঃ)

প্রবন্ধটি হাকিম সৈয়দ মাহমুদ গিলানী সংস্কৃত, উর্দু, হিন্দি, চীনা, জাপানী ও ইংরাজী সংমিশ্রণে গবেষণার আলোকে লিখিত প্রাচীন গবেষণামূলক পুস্তক “ওঁম (ঔঁ) এবং ( على) আলী (আঃ)” থেকে সংকলিত হয়েছে।

মুসলমানগণ কোন কাজ আরম্ভ করিবার পূর্বে বিছমিল্লাহির রহমানের রাহিম লিখেন ও বলেন। আল্লাহ এবং মহানবী হুজুর পাক (ছঃ) মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিয়াছেন যে, যখন কোন কাজ আরম্ভ করিবে তখন ইহার পূর্বে যেন বিছমিল্লাহ বলা হয় যাহাতে কাজে রহমত ও বরকত হয় এবং কাজটি পূর্ণভাবে সফল হয়। যে ব্যক্তি উক্ত নাম নিয়ে কাজ আরম্ভ করিবে না তাহার কাজ সফল হইবে না যদিও সফল হয় তবুও উহাতে বরকত থাকিবে না’।
—[ সূত্রঃ-মাজমুয়ায়ে সায়হায়েন ]
কিন্তু হিন্দুগণ একই উদ্দেশ্যে কোন কাজ করার পূর্বে ঔঁ (ওম) শব্দ বলেন ও লিখেন। ঔঁ সংস্কৃত ভাষার তিন অক্ষরের একটি শব্দ। ইহা স্রষ্টার নুর, শক্তি ও জালওয়াহর প্রতীক।
ধর্মবান আচার্য ( হিন্দু পণ্ডিত ) তার গ্রন্থ ‘প্রভূনিকেতন’- এ লিখিয়াছেন যে,
‘ঔঁ’ (ওম) ঈশ্বরের প্রতীক অর্থাৎ ঔঁ (ওম) আল্লাহর শক্তি। সংস্কৃত ও হিন্দিতে ‘আল্লাহ’কে ‘আলুহু’ বলা হয়, যাহা মূলে আল্লাহু বা এলাহার এক প্রতীক।

হিন্দুগণ ঔঁ (ওম) কে আল্লাহর অর্থে ব্যবহার করে। অর্থাৎ ইহাকে ঈশ্বর, পরমেশ্বর, কৰ্ত্তা, ভগবান ইত্যাদি অর্থের ন্যায় বুঝিয়া থাকেন। কিন্তু আমাদের কঠিন গবেষণা ও চিন্তা ধারায় ও যুক্তি প্রমাণের মাপকাঠিতে যাহা অনুধাবন করিতে পারিয়াছি তাহা –ঔঁ(ওম) শব্দটি আসলে আল্লাহর নাম নয় এবং আল্লাহর বিবিধ নামের সাথেও উহার কোন মিল নাই। সুতরাং উহা বস্তুতঃ আল্লাহর নামাৰ্থে ব্যবহৃত হয় না।

হিন্দু ধর্মের পণ্ডিতগণও স্বীকার করিয়াছেন যে,

“প্রভূ ইয়া পরমাত্মাকে কারণ ঔঁ (ওম) কো নেহি বারতা যাতা। হাম ইসকো এক পবিত্র নাম জাকার লিখতে আওর বোলতে হ্যায়, তাকে হামারে কাম শুদ্ধ হো যায় য়ে (পণ্ডিত গৌরী দত্ত)।

অর্থাৎ প্রভু পরমাত্মার প্রতীক ঔঁ (ওম) ব্যবহার করা হয় না। আমরা উহাকে এক পবিত্র নাম মনে করি লিখি বা বলি, যেন আমাদের কাজ শুদ্ধ ও সফলতা অর্জন করে।

[সূত্রঃ-‘রাম বিদ্যা’, লেখক পণ্ডিত গৌরী দত্ত বি, এ, শাস্ত্রী, লোধিয়ানা। প্রকাশ রিছালো ভক্তি”, লাহাের, ১৯২৩ খৃঃ, জুলাই মাস)।]

ইহা আশ্চর্যের বিষয় যে সংস্কৃত ও অন্যান্য ভাষায় আল্লাহর কোন নির্দিষ্ট নাম নাই। যেমন আরবী ভাষায় আল্লাহু নাম আছে, অবশ্য এই শব্দটিও অনেক অনেক মুসলমান জ্ঞানীগণ নির্দিষ্ট নাম হিসাবে স্বীকার করেন না। অন্যান্য ভাষায় আল্লাহর নাম যে শব্দে নির্দিষ্ট মনে করে ধরে নেয় সেসবগুলিই স্রষ্টার গুণবাচক নাম। ঔঁ (ওম) সে রকমও আল্লাহর নির্দিষ্ট বা গুণের এক নাম নয়। সংস্কৃত ভাষায় ঔঁ(ওম) এর অর্থ বিভিন্ন রূপ যেমন , শান্তি শক্তি, অনেক বল, ক্ষমতা, ক্ষমতার প্রকাশ, শানশওকত, খুব বড় শক্তি, আযমাত, হাসমত, শাহী, শাহেনশাহ, দেশ, হেকমত, বরকত, আলো, পবিত্রতা, পবিত্র জিনিষ, বড় কারীগর, সৃষ্টিকারী, সৃষ্টিকারক, স্বয়ম্ভু, ইজ্জত এবং সম্মান, ইত্যাদি।

‘ঔঁ’ (ওঁম)-এর অর্থঃ

‘ঔঁ’ (ওঁম)-এর উপরোল্লেখিত অর্থগুলি অনুধাবন করিয়া বাস্তবিকই হতভম্ভ হইতে হয়। কোন্ অর্থটি যুক্তিযুক্ত বলে মানিয়া লওয়া যায়।

পণ্ডিত হরদয়াল এম. এ. শাস্ত্রী ‘ঔঁ’ (ওঁম)–এর অর্থ নিম্নরূপ করিয়াছেনঃ-

“OM‑A holy word of Sangskrit Lan­guage which show­ing dif­fer­ent mean­ings but true mean­ings are the fol­low­ing: (1) A hand of God, (2) A pow­er of God, (3) strength of Nature.”

অনুবাদঃ-‘ঔঁ’ (ওঁম)- ইহা সংস্কৃত ভাষার এক পবিত্র শব্দ যাহা বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। কিন্তু ইহার আসল এবং নির্দিষ্ট অর্থ নিম্নরূপঃ- (১) খোদার হাত, (২) খোদার শক্তি, (৩) প্রকৃতির শক্তি।

[সূত্রঃ- ‘The Sangskrit-Eng­lish dic­tio­nary’, by Pan­dit Har­day­al M.A. sas­try pub­lished by Mahat­ma Book stall. Hall Bazar. Amrit­sar. Print­ed by Gen­er­al Elec­tric press, Amritsar/দেখুন সংস্কৃত‑ইংরাজী অভিধান — লেখক পণ্ডিত হরদয়াল এম, এ, শাস্ত্রী। প্রকাশকঃ- মহাত্মা বই ঘর, হল বাজার, অমৃতসর। মুদ্রণালয়ঃ জেনারেল ইলেকট্রিক প্রেস, অমৃতসর, ১৯০৭ খৃঃ।]

কিন্তু ডঃ কে. সি. চক্রবর্তীর অভিধানে ‘ঔঁ’ (ওঁম)–এর অর্থ নিম্নরূপঃ
(OM(1) A pow­er­ful hand of God, (2) A pow­er­ful light of God.

অনুবাদঃ- ‘ঔঁ’ (ওঁম)—(১) খোদার এক শক্তিশালী হাত (২) খোদার শক্তিশালী আলো।

[সূত্রঃ- A Mordern Dic­tio­nary of Sangskrit and Eng­lish, by K. C. chakraborty M. A. Pub­lished by Narayan Pus­tokalaya, Del­hi, print­ed by the East­ern pub­lic press, Del­hi, India, 1918./দেখুন,এ মর্ডান ডিক্সেনারী অব সংস্কৃত এণ্ড ইংলিশ। লেখক কে, সি, চক্রবর্তী এম. এ। প্রকাশক : নারায়ণ পুস্তকালয়, দিল্লী। মুদ্রণে ঃ দি ইষ্টার্ণ পাবলিক প্রেস, দিল্লী, ভারত। ১৯১৮ খৃঃ।]

ইহা ছাড়া আর, এইচ. ওয়ালফ এবং জগৎলাল ফাজিল তাদের সংস্কৃত ও ইংলিশ ডিক্সেনারীতে লিখিয়াছেন:
OM – The strength­ened hand of Nature Coach­ing the world, The father of earth, The face of God.

অনুবাদঃ- ‘ঔঁ’ (ওঁম)-প্রকৃতির এক শক্তিশালী হাত যাহা বিশ্ব জগৎকে পরিচালনা করে, ধরার পিতা, খোদার চেহারা।

[ সূত্রঃ-A key of Sangskrit Lock ; Vol. 11. by J.K. Jagat­lal M.O.L. Pub­lished by L. Moolc­hand and Sons. Book Sell­ers, Anarkali, Lahor, Print­ed by Kapour Art Press . Lahore, 1933.]

সংস্কৃত ও হিন্দির আর এক পণ্ডিত বিশ্বনাথ তাঁহার নিজের বইতে ‘ঔঁ’ (ওঁম)-এর অর্থ নিম্নরূপ করিয়াছেনঃ-
ঔঁ’ (ওঁম)- পরমাত্মা কি এক শক্তি জো ধরতি আকাশ আর সব মনুষ্যকো কাম চালাতি হ্যায়।”

অনুবাদঃ- ‘ঔঁ’ (ওঁম)-আল্লাহর এক শক্তি যাহা এই পৃথিবীর আকাশ ও সকল মানুষের কর্ম পরিচালনা করে।

উপরােক্ত পণ্ডিতগণের ব্যাখ্যা হইতে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে পৌছা যায়ঃ-

(১) খোদার হাত (২) খোদার শক্তি (৩) প্রকৃতির শক্তি (৪) আল্লাহর এক শক্তিশালী হাত ৫) খােদার এক শক্তিশালী আলাে (৬) প্রকৃতির কঠিন ও ভয়াবহ হাত, (৭) মাটির পিতা, (৮) খোদার চেহারা ইত্যাদি।

কিন্তু সংস্কৃত ভাষার অন্যান্য পণ্ডিতগণ আবার অন্যরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন। যেমন আরবীতে আলেফ, ওয়াওমিম অক্ষর দ্বারা ‘ঔঁ’ (ওঁম)-লেখা হয়। যাহার বিশ্লেষণ নিম্নরূপঃ

আলেফ—ঈশওয়ারা— আল্লাহর;
ওয়াও—ওয়ারাতানাম—খুব বড়;
মিম—মাশকাতান—অনন্ত শক্তি।

[ সূত্রঃ-সার অংশের জন্য দেখুন সংস্কৃত গাইড, লেখক এল, প্রেমচন্দ্র বিদ্যার্থী, প্রকাশকঃ প্রেম পুস্তকালয়। লুধিয়ানা। মুদ্রণালয় ও আমবেকার প্রেস, লুধিয়ানা, ১৯০৩]

(২) সংস্কৃতের আর এক পণ্ডিত নিম্নরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেনঃ

আলেফ—ঈশওয়ারা—খােদার।
ওয়াও—ওয়ারতান—ভয়াবহ।
মিম— মাহাত—হাত।।

উপরােক্ত ২টি বিশ্লেষণ থেকে (১) আল্লাহর খুব বড় ও অনন্ত শক্তি, (২) আল্লাহর ভয়াবহ হাত – এ দুটি অর্থ পাওয়া গেল। কিন্তু কেদারনাথ মুন্সী এম. এ. উভয় বিশ্লেষণকে অস্বীকার করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন যে, ‘ঔঁ’ (ওঁম)-এর প্রথম শব্দাক্ষর ‘ঈ’ নয় বরং ‘আ’। সুতরাং ঈ’র অনুসরণে ইহার বিশ্লেষণ ‘ঈশওয়ারা ঠিক নয়। ‘আ’র অনুসরণের বিশ্লেষণ নিম্নরূপঃ

আলিফ—আমাকারা—আসায়াওয়ার দরজা।
ওয়াও—ওয়াদ্দীয়া—বিদ্যা।
মিম—মহত্তম—জ্ঞান।

দরজাকে আরবীতে ‘বাব’ বলা হয়। কেদারনাথের মত অনুযায়ী ‘ঔঁ’ (ওঁম)-এর অর্থ হইল ‘জ্ঞান বিদ্যার দরজা’। এখানে লক্ষ্য করা দরকার যে, উহা কোন্ মহাপুরুষ। যাহাকে জ্ঞানবিদ্যার দরজা বলা হইয়াছে। সে ব্যক্তি হযরত আলী ইবনে আবু তালিব ব্যতীত কেহই হইতে পারেন না। কারণ তাহার শানেই রছুল করীম (ঃ) বলিয়াছেন, ‘আনা মাদিনাতুল ইম ওয়া আলীউন বাবােহা” অর্থাৎ ‘আমি বিদ্যার শহর এবং আলী উহার দরজা।” তাছাড়া ইতিহাসে অথবা এমন কোন ধর্মীয় তথ্য বা দলিল নাই যাহা দ্বারা অন্য কাহাকেও জ্ঞানের দরজা বলে সপ্রমাণ করা যায়। বলা বাহুল্য, কেহ এ ধরনের দাবীও করে নাই। সুতরাং ‘ঔঁ’ (ওঁম)-একমাত্র আলী (আঃ ) ব্যতীত দ্বিতীয় কেহ নয়। [ সূত্রঃ-ব্যাখ্যার জন্য দেখুন — হামারই প্রচীন বুলি-লেখক কেদার নাথ ]

পুনরায় নিরপেক্ষ জ্ঞান ও চিন্তাধারার মধ্যে আরাে বিবেচনা করিয়া দেখা দরকার যে আল্লাহর হাত, আল্লাহর শক্তি, প্রকৃতির শক্তি, খােদার শক্তিশালী হাত ও খােদার ভয়াবহ হাত, কে? যাহার অনুসরণে ‘ঔঁ’ (ওঁম)-শব্দ ব্যবহার করা হয়!

সংকলন
সৈয়দ হোসাইন উল হক
ম‑ফিল,ইসলামিক স্টাডিজ এন্ড হিস্টোরি,অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি।

1 Comment

মতামত দিন