প্রবন্ধ

সিলেটে ইসলাম প্রচারক সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (র.)

সিলেটে ইসলাম প্রচারক সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (র.) : মুহাম্মদ রুহুল আমীন নগরী 

মহান দরবেশ হযরত শাহজালাল (র.)এর নেতৃত্বে যখন মুজাহিদবাহিনী যখন সিলেট জয় করেন তখন গৌর গোবিন্দের মন্ত্রী মনা রায়ের (মনোরঞ্জন রায়) বাড়ী ছিল বর্তমান সিভিল সার্জন অফিসের পূর্বের টিলায়। সিলেট বিজয়ের সময় আযানের ধ্বনিতে রাজপ্রাসাদ ভেঙ্গে যায়। গৌড় গোবিন্দ আগেই এখান থেকে রাজধানী পেঁচাগড়ে স্থানন্তরিত করে ছিলেন। সেনাপতি মনোরঞ্জন রায় (মনা রায়)কে দিয়ে যান এ বাড়ী। পেঁচাগড় (মানলিছড়া ও তারাপুর চা-বাগান এলাকা বলে গবেষকদের অভিমত) দূর্গের প্রবেশ পথ ছিল গড় দোয়ার (বর্তমান আম্বারখানা-মজুমদারী-চৌকিদেখী-হাউজিং এস্টেট প্রভৃতি মহল্লাহ)। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে হযরত শাহজালাল (র) এর রূহানী শক্তিতে সিলেটের জমিনে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা লাভকরে। এই মুজাহিদ বাহিনীর যিনি দিল্লী ও বাংলার সৈন্যদের নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন তাঁর নাম পীরে কামেল সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (র)। সিলেট বিজয়ের পর গৌড় গোবিন্দের সমসাময়িক রাজা আচাক নারায়ণের রাজ্য রাজপুর বা তুঙ্গাচল (পরে তরপ, বর্তমানে হবিগঞ্জ জেলা) বিজিত হয় সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (র)’র নেতৃত্বে। এই অভিযান বারোজন আওলিয়া অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে তরপকে বার আওলিয়ার মুল্লুক বলে অভিহিত করা হয়। সূফী সাধনা ও সৃজনশীল সাহিত্য চর্চা তথা মনন চর্চার এমন কোন দিগন্ত ও প্রান্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না- যেখানে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (র.)’র অধঃস্থন পুরুষরা বিশেষ অবদান রেখে ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে রাখেনি। সিলেট বিজয়ের পর এখানে যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব সংঘটিত হয়- এর পয়লা কাতারে ছিলেন সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (র.)’র সুযোগ্য বংশধরগণ।

সংক্ষিপ্ত জীবনী
সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের সাথে বার জন আউলিয়া তরফ রাজ্যে আগমন করেছিলেন। তাঁদের প্রভাবে তরফ রাজ্য বিজিত হওয়ায় এটি বার আউলিয়ার মুলুক বলে খ্যাত হয়। অতপর তরফে মুসলমানদের অধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে, উক্ত বার আউলিয়া ইসলামের বাণী নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে গমন পূর্বক ধর্ম সাধনায় নিয়োজিত হন। তাঁদের অধ্যুষিত স্থানে নিজ নিজ নামে একেকটি দরগাহ বা মাজার বিদ্যমান আছে। এদিকে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন তরফের শাসনভার প্রাপ্ত হন। তিনি সৈন্য গণ সহ যে স্থানে বাস করে রাজ্য পরিচালনা করেন, সে স্থান লস্কর পুর নামে খাত্য হয়।
সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন সময় সময় সিলেট গিয়ে দরবেশ শাহ জালালের সাথে সাক্ষাত করতেন। সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের পরে তাঁর পুত্র সিরাজ উদ্দীন তরফের শাসনভার প্রাপ্ত হন। এই সিরাজ উদ্দীনের থেকে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের বংশ বিস্তৃত হয়। পরবর্তিতে তাঁর বংশ হতে ওলী-আউলিয়া শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ সহ অনেক জ্ঞানী-গুণীর আবির্ভাব ঘটে। শ্রীহট্টে ইসলাম জ্যোতি সহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে পাওয়া যায়; শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যের অধিবাসী বুরহান উদ্দীন নামক জৈনক মুসলমান নিজ ছেলের জন্ম উত্সব (আক্বিকা) উপলক্ষে গরু জবাই করে গৌড়ের হিন্দু রাজা গৌড়গোবিন্দের কাছে অপরাধি সাবস্ত হন। ফলে গোবিন্দ বুরহান উদ্দীনের শিশু ছেলেকে ধরে নিয়ে হ্ত্যা করে। বুরহান উদ্দীন বাংলার তৎ্কালীন রাজা শামস উদ্দীন ফিরুজ শাহের নিকট গিয়ে এই নিষ্ঠুর হ্ত্যা কাণ্ডের অভিযোগ করলে রাজা তাঁর ভাগিনে সিকান্দর গাজীকে সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যে প্রেরণ করেন। সৈয়দ নাসির উদ্দীনকে সম্রাট সিপাহসালার সনদ প্রদানের মধ্যে সিকান্দর গাজীর কাছে প্রেরণ করেন। সে থেকে তিনি সৈয়দ নাসির উদ্দীন হতে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন নামে খ্যাত হন।

বংশ পরিচিতিঃ
হযরত নাসির উদ্দিন সিপাহ্সালার (রহঃ) ছিলেন হযরত ঈমাম হোসাইনের (রাঃ) চতুর্দশতম বংশধর । তাঁর পিতার নাম ছিল হযরত সৈয়্যদ হাসান আল আরাবী (রহঃ)। তাঁর বংশ লতিকা নিম্নরুপ-
১। হযরত ঈমাম হোসাইন (রাঃ)
২। হযরত ঈমাম জয়নুল আবেদীন (রহঃ)
৩। হযরত ঈমাম বাকের (রহঃ)
৪। হযরত ঈমাম জাফর আস সাদিক (রহঃ)
৫। হযরত ঈমাম মুসা আল কাযিম (রহঃ)
৬। হযরত ঈমাম মুসা আল রেযা (রহঃ)
৭। হযরত ঈমাম আলী আত তাকী (রহঃ)
৮। হযরত ঈমাম আলী আন নাকী (রহঃ)
৯। হযরত ঈমাম হাসান আল আসকারী (রহঃ)
১০। হযরত আলী আল মাহদী (রহঃ)
১১। হযরত আবুল ফজল (রহঃ)
১২। হযরত আবুল ফাত্তাহ (রহঃ)
১৩। হযরত দাউদ আত তায়ী (রহঃ)
১৪। হযরত হাসান আল আরাবী (রহঃ)
১৫। হযরত নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (রহঃ)
উত্তরাধিকারসুত্রে তিনি পেয়েছিলেন – অনমনীয় জিহাদী চেতনা এবং ইসলাম প্রচারের অদম্য বাসনা। দিল্লীর অধিবাসী হযরত নাসির উদ্দিন সিপাহ্সালার (রহঃ) ছিলেন হযরত শাহ্জালালের (রহঃ) সহযোদ্ধা। প্রথম জীবনে তিনি দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ্ তুঘলকের অধীনে সেনাবিভাগে চাকুরী করতেন। পরে তিনি সুলতান কর্তৃক সিপাহ্সালার পদে নিযুক্তি লাভ করেন। সুলতানের আত্মীয় ও সেনাপতি সিকান্দার শাহ্ গাজীর সহযোগীতা করার জন্য সিলেট অভিযানে প্রেরিত হন। এলাহাবাদে এসে তাঁর সাথে হযরত শাহজালালের (রহঃ) সাক্ষাত হয়। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ৩৬০ জন আউলিয়া। ১৩০১ খৃষ্টাব্দে উভয়ে মিলিতভাবে সিলেটের তৎকালীন হিন্দু রাজা গৌর গোবিন্দকে পরাজিত করেন।
এরপর হযরত শাহজালালের (রহঃ) নির্দেশে তিনি নিকটবতী তরফ রাজ্যে অভিযান পরিচালনা করেন। তিন হাজার পদাতিক ও এক হাজার অশ্বারোহী নিয়ে হযরত নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (রহঃ) তরফ বিজয়াভিযানে অগ্রসর হন। বর্তমান হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার অংশ বিশেষ, ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া জেলার কিছু অংশ ও পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর পূর্বাংশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল তখনকার তরফ রাজ্য। বর্তমান ভারত‑বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী খোয়াই নদীর তীরে বাল্লার নিকটর্বতী বিষগাঁয়ে ছিল তরফ রাজ্যের রাজধানী ও তরফের রাজা আচক নারায়ণের রাজ‑বাড়ী। প্রানভয়ে ভীত রাজা আচক নারায়ণ, হযরত নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (রহঃ) এর কাছে সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হয়ে পাশ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় নেন। ত্রিপুরার রাজার কাছে সাহায্য কামনা করেও বিফলকাম হন। হতাশ ও নিরুপায় রাজা আচক নারায়ণ অবশেষে, ভগ্ন হৃদয়ে সেখান থেকে মথুরায় তীর্থ ভ্রমনে গিয়ে তথায় ম্ত্যৃু বরণ করেন। ফলে, বিনা বাধায় বিজিত হয় তরফ রাজ্য। আচক নারায়ণের বিরুদ্ধে এ সমরাভিযানে হযরত নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (রহঃ) এর সঙ্গে ছিলেন বারো জন আউলিয়া।
তরফ বিজয়ের পর হযরত নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (রহঃ) তরফের শাসক নিযুক্ত হন। হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলাধীন খোয়াই নদী বিধৌত মুড়ারবন্দে তাঁর মাজার রয়েছে।

ইন্তেকাল ও মাজার :
সিপাহসালার সৈযদ নাসির উদ্দিন (র)’র মাজার হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার মুড়ারবন্দ দরগাহ শরীফে বিদ্যমান বলে ইতিহাস পাঠে জানাযায়। সৈয়দ মোস্তফা কামাল লিখেন, আমরা যতটুকু জানি চৌকি বলতে সীমানা পাহাড়া বা প্রহড়ার স্থানকে বুঝায়। এ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তির পদবী চৌকিদার। মুসলিম বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে যেখানে গৌড় গোবিন্দ একটি সীমান্ত পাহারা বসিয়ে ছিলেন সে স্থানের নাম হয়েছে চৌকি। চৌকি এখন নবীগঞ্জ উপজেলার একটি ঐতিহাসিক গ্রাম ও পরগনার নাম। বলা হয়েছে, ‘অতঃপর কিছুকাল রাজ্য ভোগান্তে নাসির উদ্দিন পরলোক গমন করেন।’ এতে বুঝ যায় তিনি তরপে ইন্তেকাল করেন। কারণ সিলেটের তাঁর রাজ্য ছিল না। শুধু পীর মহল্লার আদিনা মসজিদে তাঁর লাশ রাখা ও গায়েব হওয়ার জন্য তিনি মৃত্যুর আগে সিলেটে চলে এসে ছিলেন তাও মেনে নেয়া যায় না। এইসব পরস্পর বিরোধী কথাবার্তা পাঠককে খটকায় ফেলে দেয়। আরো মজার বিষয়, লাশ রাখা হলো ও গায়েব হলো সিলেট শহরের পীর মহল্লায়। চৌকি থেকে লাশ গায়ের হওয়ার পর লাশ নাই- দেখা যাচ্ছে চৌকি। এ কারণে তার মতে স্থানের নাম হয়েছে চৌকিদেখী। তার সূত্র মতে স্বাভাবিক নিয়মে পীর মহল্লার নাম হওয়ার কথা চৌকিদেখী। তা না হয়ে চৌকিদেখী নাম হলো অন্য আরেকটি মহল্লার। এর কি ব্যাখ্যা হবে তা বিজ্ঞ পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম। বর্তমান সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৬নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত মহল্লাগুলো হচ্ছে ঃ ১. পীর মহল্লাহ ২. সৈয়দ মুগনী ৩. মালীপাড়া, বাদাম বাগিচা ৪. চৌকিদেখী পূর্ব ৫. চৌকিদেখী পশ্চিম। চৌকি দিঘি > চৌকিদেখী স্থানে হয়তো তখন গৌড় গোবিন্দের আরেকটি চৌকি বা পাহাড়ার (চেকপোস্ট) স্থান ছিল। এটাই প্রকৃত সত্য।’
আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগে হযরত নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (রহঃ) এর ওফাত হয়। বর্তমান মুড়ারবন্দ তৎকালে ছিল ছায়াঘেরা বনানী। চারিদিকে কোন মানুষজনের আবাদী বিহীন, নিভৃত‑নিরিবিলি এ স্হানটিকে পরম নিশ্চিন্তে ইবাদাত‑বন্দেগী করার যোগ্য জায়গা হিসেবে খুবই পছন্দ হয়ে গেল হযরত নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (রহঃ) সাহেবের। তাই সেখানেই ঘাটি গেড়ে স্হায়ীভাবে থেকে গেলেন তিনি।

মন্তব্য

Leave a Reply to Anonymous