প্রবন্ধ

ইতিহাসের নামে কিচ্ছা- কিংবদন্তি ও ব্রেইন মেইড স্টোরি

প্রকাশিত: শনিবার ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ | প্রিন্ট সংস্করণ । দৈনিক সংরাম । আর্কাইভ। সম্পাদকঃ আবুল আসাদ ।

প্রয়াত গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামাল সাহেবের ‘প্রসঙ্গ বিচিত্রা’ গ্রন্থ থেকে নেয়া প্রবন্ধ :  ইতিহাসের নামে কিচ্ছা- কিংবদন্তি ও ব্রেইন মেইড স্টোরি

কাল পরিক্রমায় সিলেট শহর এখন সিটি কর্পোরেশন। মেট্রোপলিটন সিটি। বিভাগীয় হেড কোয়ার্টার। সিলেট একটি প্রাচীন জনপদ হলেও ইতিহাসবিদদের অভিমতের কোন ধারাবাহিক প্রামাণ্য ইতিহাস নেই। কিচ্ছা-কিংবদন্তি, স্মৃতি-শ্রুতি, বিদেশী ভ্রমণকারীদের সফরনামা, শিলালিপি, তামারপাতে খুদিত বিবরণীর মাধ্যমে অতীত দিনের সিলেট সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়।

হিস্টরী এন্ড স্ট্যাটিস্টিকস অব ঢাকা ডিভিশন, প্রকাশকাল, কলিকাতা ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ। এ গ্রন্থে বলা হয়েছে : Noth­ing is known with cer­tain­ly con­cern­ing the ancient His­to­ry of Syl­het. The first inhab­i­tants were prob­a­bly small set­tle­ments from the Hills which sur­round it. These seem to have been con­vert­ed or dri­ven away by Hin­doos, or more prob­a­bly Bud­dists from Asam. In ear­ly times the Dis­trict appears to have been more or less sub­ject to the Kam­roop Empire and to have no con­nec­tion with any kin­dom in low­er or west­ern Bengle.

বিস্তারিত দেখুন: হযরত শাহ্জালাল (রঃ) দলিল ও ভাষ্য: দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা। ৩৬৬-৩৬৮ পৃষ্ঠা।

সিলেট একটি প্রাচীন শহর এতে কোন সন্দেহ নেই, তবে শ্রীহট্ট নাম অনেক পরের। এটা সংস্কৃত প-িতদের ব্রেইন মেইড স্টোরির উদ্ভাবন বলা যায়। গৌড় গোবিন্দ সিলেটের শেষ হিন্দু নরপতি। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি হযরত শাহ্জালাল (রঃ)-এর বাহিনীর কাছে পরাজিত হন। গৌড় গোবিন্দের বংশ বৃত্তান্ত বিষয়েও নেই কোন প্রামাণ্য ইতিহাস। গৌড় গোবিন্দ সম্পর্কে শ্রী অচ্যুত চরণ চৌধুরী তার রচিত শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে লিখেছেন এক অদ্ভুত কল্পকাহিনী। তিনি বলেছেন :

.… গোবিন্দের পিতার নাম কি ছিল, জানা যায় না। কিংবদন্তি মতে, তিনি সমুদ্র তনয়। কথিত আছে যে, পূর্বকালে ত্রৈপুর রাজবংশের কোন রাজার শত শত মহিষী (স্ত্রী) ছিল। সমুদ্রদেব (বরুণ দেব) তন্মধ্যে কোন মহিষীর সহিত মনুষ্যাকারে সম্মিলিত হন। তার কৃপাতেই রাণী গর্ভধারণ করেন। এই গর্ভের কথা প্রকাশিত হলে রাজা সেই রাণীকে নির্বাসিত করেন। তদাবস্থায় রাণী এক সুলক্ষণান্বিত পুত্র প্রসব করেন। সমুদ্র দেব তখন আবির্ভূত হয়ে রাণীকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, তার অভিপ্রায়ে সমুদ্রের জলে যতদূর চরা পড়িবে নবজাত শিশুও ততদূর পর্যন্ত রাজ্যাধিকার লাভ করতে পারবে। এ নির্বাসিত মহিষীর পুত্রই গোবিন্দ।

[বিস্তারিত দেখুন: শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত: পূর্বাংশ, প্রথম অধ্যায়, দ্বিতীয় ভাগ, দ্বিতীয় খ, পৃষ্ঠা-৪, উৎস প্রকাশন সংস্করণ।]

ইতিহাসের নিক্তিতে উল্লিখিত কথাগুলো বিচার করলে ইতিহাসের নামে চালিয়ে দেয়া এসব কিচ্ছার কোন বাস্তবতা পাওয়া যায় না। প্রথমেই বলা হয়েছে, গৌড় গোবিন্দের পিতার নাম কি তা জানা যায় না। তাহলে সমুদ্র দেব (বরুণ দেব) গৌড় গোবিন্দের কি হন? কোন এক ত্রৈপুর রাজার শত শত স্ত্রী ছিল কথাটা কি বাস্তবিকই সত্য। একজন দেবতা কিভাবে মানব সন্তানের স্ত্রীর সাথে অবৈধভাবে মিলিত হলেন? যদি এটা দেবতার লীলা বলে চালিয়ে দেয়া হয় তাহলে আমাদের কিছুই বলার নেই। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হোক না কেন, এ সব কল্পকাহিনীকে ইতিহাস বলা যায় না। এ কিচ্ছার সময়কাল বারশ’ খ্রিস্টাব্দ। এটাকে পৌরাণিক বলেও চালিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। অথচ এক্ষেত্রে হয়েছে তাই।

অপরদিকে হট্টনাথের পাচালী মতে, গৌড় গোবিন্দ ব্রহ্মাচলরাজ আনন্দের পলাতক পুত্র। তিনি বারজন সঙ্গী নিয়ে কোন এক সন্যাসীর আশ্রমে আশ্রয় নেন। খুব সম্ভব এই সন্যাসীই ছিলেন গৌড় গোবিন্দের পিতা আনন্দ। সন্যাসী গোবিন্দ ও তার সঙ্গী-সাথীদের যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা দেন। পিতৃ রাজ্য উদ্ধারের জন্য প্ররোচিত করেন। গোবিন্দ হঠাৎ আক্রমণ করে গৌড় রাজ্য দখল করেন। শেষে সন্যাসী তার আসল পরিচয় প্রকাশ করেন। গোবিন্দ গোবর্ধন মহিষীর আদেশক্রমে গৌড়ের সিংহাসনে বসেন। এ কাহিনীর ঐতিহাসিক ভিত্তিও তেমন মজবুত নয়।

১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত শ্রীহট্টের ইতিহাস নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে আরও মনগড়া কিচ্ছা-কাহিনী :

শ্রীহট্টে মুসলমানের আগমন : ১২৫৩ খৃস্টাব্দে সম্রাট নাসিরুদ্দিন মামুনের রাজত্বকালে মালিক ইয়াজবেক বাঙ্গালার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তিনি প্রথমত: উড়িষ্যারাজের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন। উড়িষ্যারাজকে পরাজিত করিয়া তিনি শ্রীহট্টাভিমুখে গমন করেন। তথায় হিন্দু রাজের সহিত মালিক ইয়াজবেকের ঘোরতর যুদ্ধ হয় এবং সেই যুদ্ধে হিন্দুগণ পরাজিত হওয়াতে শ্রীহট্ট মুসলমান রাজ্যভুক্ত হয়। মালিক ইয়াজবেক তৎপরে আসাম‑রাজের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন এবং এই যুদ্ধে তিনি নিহত হন। ইয়াজবেক যুদ্ধে নিহত হইলে হিন্দুদিগের পুনরায় রাজ্য বিস্তার হয়। ইহার পরে ১৩৮৩ খৃস্টাব্দে রাজা গণেশ কর্তৃক বঙ্গাধিপতি গিয়াসউদ্দিনের পুত্র রাজ্যচ্যুত হন। এ সময়ে শ্রীহট্টে সমুদ্রসেনের পুত্র খ্যাতনামা গৌরগোবিন্দের শাসনাধীনে ছিল। এক সময়ে গৌড় গোবিন্দের মহিষী ভয়ানক রোগে পীড়িত হইলে দেশের সমস্ত খ্যাতনামা চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা করাইয়া কোনও উপকার না পাওয়াতে, মহারাজ গৌড় গোবিন্দ রাঢ় দেশ হইতে চক্রপানি দত্তকে আনয়ন করেন। এই চক্রপানি দত্ত লাখাইর দত্ত বংশের আদিপুরুষ। চক্রপানি দত্তের চিকিৎসায় মহিষী আরোগ্যলাভ করিলে, মহারাজ সন্তুষ্ট হইয়া উক্ত চক্রপানি দত্তকে শ্রীহট্টে থাকিবার জন্য বিশেষ অনুরোধ করেন। মহারাজের অনুরোধ অতিক্রম করিতে না পারিয়া, তিনি তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্র মহীপতিকে শ্রীহট্টে রাখিয়া স্বদেশে প্রত্যাগমন করেন।

এই গ্রন্থে হযরত শাহ্জালাল (রঃ) প্রসঙ্গে বলা হয়েছে :‘দরবেশ সাহজালাল : এমন (ইয়েমেন) দেশবাসী সাহজালাল ৩৬০ জন দরবেশসহ দেশ ভ্রমণে বহির্গত হন। দরবেশ সাহজালাল শ্রীহট্টের কোন স্থানে আসিয়া বাস করিতে ছিলেন। ঐ সময়ে বরাহেনউদ্দীন নামক জনৈক বিখ্যাত পীর শ্রীহট্ট সহরে বাস করিতে ছিলেন, তিনি তখন গোহত্যা করিয়া ছিন্নি দেন, এই জন্য রাজা গৌরগোবিন্দ কর্তৃক অপমানিত ও লাঞ্ছিত হন। বিখ্যাত মূর ভ্রমণকারী ইব্ন বাতোতা ১৩৫২ খৃস্টাব্দে শ্রীহট্ট প্রদেশে সাহজালালকে দেখিতে পান। সেই সময় সাহজালাল ইব্ন বাতোতার সঙ্গে একটি খিলকা পীর বরাহেনউদ্দীনকে দেন। তিনি পূর্ব হইতে বরাহেনউদ্দীনকে চিনিতেন। নবাব সামসুদ্দিন কতক দেশ জয় করার পর ১৩৪৭ খৃস্টাব্দে ত্রিপুরা আক্রমণ করেন, তৎপর মুসলমান বরাহেনউদ্দীনের অপমান বার্তা শ্রবণ করিয়া স্বীয় পুত্র সুলতান সেকান্দরকে শ্রীহট্টাধিপতির অপমান বার্তা শ্রবণ করিয়া স্বীয় পুত্র সুলতান সেকান্দরকে শ্রীহট্টাধিপতির বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। কিন্তু তিনি শ্রীহট্টাধিপতির কৌশলে পরাজিত হইয়া তদ্দেশ পরিত্যাগ করেন। ১৩৮৪ খৃস্টাব্দে সাহজালাল, পীরের অপমানের সংবাদ শ্রবণান্তে পীর দর্শনে অভিলাষী হইয়া এবং গৌরগোবিন্দকে জব্দ করার মানসে শ্রীহট্টে আগমন করেন। দরবেশ সাহজালালের আগমন বার্তা শ্রবণ করিয়া, রাজা গৌরগোবিন্দ উদ্বিগ্ন হইলেন এবং যাহাতে দরবেশ সুরমা নদী পার হইতে না পারেন সে বিষয়ে বিশেষ বন্দোবস্ত করিলেন, কিন্তু দরবেশ সাহজালাল নদী পার হইলেন। রাজা গৌরগোবিন্দ স্বভাবতঃ ধর্মভীরু ছিলেন, তিনি মুসলমানের আগমনে স্বধর্ম রক্ষার জন্য বাড়ি পরিত্যাগ করেন। সাহজালাল রাজবাড়ী ভাঙ্গিয়া তথায় এক সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করেন এবং সেকান্দর গাজীকে শ্রীহট্টের শাসনকর্তৃত্বে নিযুক্ত করেন। ১৮৫০ খৃষ্টাব্দে দিল্লীর সর্বশেষ স¤্রাট ফিরোজ সাহ এই দরগা দেখিতে শ্রীহট্ট আসিয়াছিলেন। এই দরগার ব্যয় নির্বাহার্থে গভর্নমেন্ট হইতে বার্ষিক (১২০০) বারশত টাকা প্রদত্ত হয়।’ (বইয়ের ভাষা ও বানান অবিকল রাখা হয়েছে।) রাজবাড়ী ভেঙে মসজিদ তৈরির বর্ণনা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ভিন্ন মতলবে। এভাবেই ইতিহাসের নামে বৃষ বৃক্ষের জন্ম দেয়া হয়েছে। এই গ্রন্থের ৩০ পৃষ্ঠায় লেখক ইংরেজের গুণগান করেছেন এভাবে :

.…. ইংরেজ গভর্নমেন্ট কর্তৃক এই দেশের অশেষবিদ মঙ্গল সাধিত হইতেছে। পূর্বে স্থানীয় রাজাগণ প্রায়ই পরস্পর যুদ্ধ বিগ্রহে রত থাকিতেন; তাহাতে প্রজাদিগের যৎপরোনাস্তি অনিষ্ট হইত কিন্তু ইংরেজাধিকারের পর শ্রীহট্টে শান্তি স্থাপন হইয়াছে।.…

(বিস্তারিত দেখুন : শ্রীহট্টের ইতিহাস : শ্রীমোহিনীমোহন দাস গুপ্ত। সংগ্রহ ও সম্পাদনা : রব্বানী চৌধুরী- উৎস প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে)

একশ’ বছর পর কষ্ট করে আগ‑পিছ চিন্তাভাবনা না করে লন্ডন থেকে একটি ভুল তথ্য ও বিকৃত ইতিহাস, যে বইয়ে হযরত শাহজালাল (রঃ)কে হিন্দুবিদ্বেষী ও গৌড় গোবিন্দের রাজবাড়ী দখল করে মসজিদ নির্মাণকারী হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে, সে বইটি পুনঃমুদ্রণের আগে বইটি ভাল করে ভালভাবে পড়ে নেয়া উচিত ছিল। বিবেচনা করা প্রয়োজন ছিল- এ দ্বারা সমাজে কোন ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে কিনা। বিভ্রান্তির বিস্তার রোধের জন্য ও এসব জাতি বিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন ছিল। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত কৃষ্ণ কুমার পাল চৌধুরী সম্পাদিত ‘সিলেট কথা’ গ্রন্থে ‘স্মরণীয় বরণীয়’ অধ্যায়ে অত্যাচারী রাজা গৌড় গোবিন্দকে হযরত শাহ্জালাল (রঃ)-এর উপরে স্থান দেয়ায় সিলেটে বিক্ষোভ হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বইটি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ- ঢাকায় প্রেরণ করেন, সার্বিক পর্যালোচনা করে রিপোর্ট দেয়ার জন্য। কমিটি হিন্দু মুসলিম অনেক লেখক-গবেষক কবি সাহিত্যিকের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে অভিমত দেন, হযরত শাহ্জালাল (রঃ) ছিলেন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন এমন কোন প্রমাণ নেই। এ দেশে ইসলাম প্রচারে ওলিকুল গৌরব হযরত শাহ্জালাল (রঃ)-এর অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। তিনি ও তাঁর সঙ্গী-সাথী আউলিয়া ক্বেরামের মানবতাবাদী আদর্শের জন্য জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার শ্রদ্ধা লাভ করেন। কৃষ্ণকুমার পালের সম্পাদিত বইয়ে অত্যাচারী-জালিম মুসলিম বিদ্বেষী গৌড় গোবিন্দকে শাহ্জালাল (রঃ)-এর উপরে স্থান দেয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম জনতার মনে বেদনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। লেখক পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সরকার এক আদেশ দিয়ে বইটির বিক্রয় ও বিতরণ বন্ধ করে দেন।

ইতিহাস বলেন, এদেশ ইংরেজ দখলের পর হিন্দু ও খ্রিস্টান লেখকগণ সচেতনভাবে মুসলমানদের অত্যাচারী প্রমাণের জন্য গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে লেখনীর মাধ্যমে। এ বিষয়ে আবুল মনসুর আহমদ বলেছেন :

“.…. নয়া শাসকরা খুব স্বাভাবিক কারণেই মুসলমানদের দাবাইয়া হিন্দুদের টানিয়া তুলিবার সকল প্রকার ব্যবস্থা করেন। তারা চাকরি-বাকরিতে, সহায়‑সম্পত্তিতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে মুসলমানদের তাড়াইয়া হিন্দুদের বসাইবেন, এটাও ছিল স্বাভাবিক ও সঙ্গত। কিন্তু এই সঙ্গে তারা ঘোরতর অন্যায় অসঙ্গত একটা পন্থা গ্রহণ করিলেন। সেটা ইতিহাসকে বিকৃত করা। সে বিকৃতি ঘটান হইলে মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের মন বিষাইয়া তোলার উদ্দেশ্য। ৬০০ বছরের মুসলিম শাসনের ভাল দিকের সাথে কিছু কিছু খারাপ দিকও ছিল নিশ্চয়ই। ইংরেজরা বাছিয়া বাছিয়া ঐসব খারাপ দিকে রং ছড়াইয়া ও কল্পনার আশ্রয় লইয়া এমন সব ইতিহাস লিখিলেন যাতে প্রমাণ করার চেষ্টা হইল যে, মুসলমানরা হিন্দু ধর্ম হিন্দু নারীর সতিত্ব নষ্ট করিয়াছে। হিন্দুদের ভাষা-সংস্কৃতি ধ্বংস করিবার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দ ঢুকাইয়া তারা ভাষার সতীত্ব নষ্ট করিয়াছে। খৃস্টান পাদ্রীরা বাংলা ভাষায় প্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দ দেখাইবার জন্য ইংরিজতে বাংলা ভাষার অভিধান রচনা করিলেন‑বিশুদ্ধ বাংলায়, মানে সংস্কৃত বহুল ভাষায়। তারা নিজেরাই সাপ্তাহিক সংবাদপত্র বাহির করিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মৃত্যুঞ্জয় তর্কালংকারকে দিয়া ‘বিশুদ্ধ বাংলা’ প্রচলন করিলেন। মোটকথা, হিন্দু-মুসলিম বিরোধ ঘটানোকে ইংরেজরা প্রকাশ্যভাবে সরকারি নীতি হিসাবেই গ্রহণ করিলেন।…”

বিস্তারিত দেখুন : বাংলাদেশের কালচার : আবুল মনসুর আহমদ, তৃতীয় মুদ্রণÑ ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা ২৭১-২৭৩)।

সিলেট শহরের চৌহাট্টার উত্তরে মনারায়ের (মনোরঞ্জন রায়) টিলার উপরে দীর্ঘকাল রাজ প্রাসাদ ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেন। গৌড় গোবিন্দের আগের রাজাগণ এখানে বাস করতেন। গৌড় গোবিন্দ সাধারণ অবস্থা থেকে স্বীয় প্রতিভা বলে নিজেকে শক্তিশালী নৃপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। গৌড় গোবিন্দ রাজপ্রাসাদ পেঁচাগড়ে স্থানান্তরিত করেন। মন্ত্রী মনারায়কে পুরাতন প্রাসাদ দিয়ে যান। মন্ত্রী মনারায়ের নামে পরিচিত হয় এ টিলাÑ যার নাম মনারায়ের টিলা। আগেই বলা হয়েছে গৌড় গোবিন্দের পরিবার পেঁচাগড় প্রাসাদে বাস করতেন। পেঁচাগড়ে এখনো প্রাচীন ইমারতের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। গড়দোয়ার আম্বরখানা, রাজারগল্লী, মজুমদারী, রাজারমার দীঘি, হাউজিং এস্টেট, দর্শন দেউড়ীর স্থান নিয়ে ছিল বলে ইতিহাসবিদগণ অনুমান করেন। হট্টনাথের পাঁচালী ও পাগলা ঠাকুরের বর্ণনায় এইসব তথ্য পাওয়া যায়। ভবানী প্রসাদ দত্তের লিপি ও পাগলা ঠাকুরের ছড়ায় বলা হয়েছে :

সমুদ্র তনয় গৌড় গোবিন্দ নামেতে

শ্রীহট্ট দেশের রাজা ছিলেন পর্বতে।

এটা কবিতা। ইতিহাস হবার যোগ্যতা রাখে না। গৌড় গোবিন্দ বিয়ে করেন রাজপুরের (তরপের) রাজা আচাক নারায়ণের ভগ্নি শান্তিপ্রিয়াকে। এ পর্যন্ত যা বলা হলো তা কতটুকু ইতিহাস এবং কতটুকু কিচ্ছা-কাহিনী এর বিচারের ভার রইলো বিজ্ঞ পাঠকদের উপর।

বিস্তারিত দেখুন : সিলেটের মাটি সিলেটের মানুষ : ফজলুর রহমান।

ইয়াদ রাখা প্রয়োজন, এক সময় ইতিহাসের নামে বানানো গল্প, কথা- উপকথা, কিচ্ছা-কাহিনী, ধর্মাশ্রয়ী ধ্যান‑ধারনা মিশ্রিত খামিরা হয়ে যেত পুরাণ। অথচ পুরাণ বিশ্বস্ত ইতিহাসের দাবি করতে পারে না। বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস এলো মুসলিম আমলে। মুসলমানরা এদেশে আসার আগে এ দেশের অধিবাসীদের কোন জাতি পরিচয় ছিল না। এমনকি তাদের আধ্যাত্মিক‑সাংস্কৃতিক ও জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিও ছিল অনেক দুর্বল। মুসলমানরাই এদেশবাসীকে হিন্দু বলে অভিহিত করে তাদের ঐক্যের ভিত্তি মজবুত করে দিয়ে ছিলেন। ভারত বর্ষকে বলা হলো মুলকে হিন্দ। কারণ আর্যরা প্রথমে সিন্ধু নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে ছিল। এজন্য সিন্ধু থেকে হিন্দ্ > হিন্দু শব্দের উৎপত্তি। তলোয়ার দিয়ে নয়- হৃদয়ের দ্বার উন্মোচন করে প্রেম ও ভালবাসার ডুরে আবদ্ধ করেছিলেন এ দেশবাসীকে। মুসলিম আগমনের আগে প্রাচীন কালে সিলেটের ইতিহাস লেখা হয় নাই। আরব ও আজমের মাঝে যিনি ঐতিহাসিক সেতুবন্ধন স্থাপন করে ছিলেন তাঁর নাম আল বিরুনী (জন্ম- ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি যে ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনা করেছেন এর নাম কিতাবুল হিন্দ্ (কিতাব আল তারিখিল হিন্দ্), রচনাকাল ১০৩০ খ্রিস্টাব্দ। এই গ্রন্থে সিলেটকে বলা হয়েছে, সিলাহাত। আরবীতে ‘ট’ বর্ণ নেই। তাই সিলেট হয়ে গেছে সিলাহাত।

সিলেটের মাটি ও আরবের মাটি

হযরত শাহজালাল (র) যখন তাঁর শায়েখের নির্দেশে আরব দেশ থেকে পূর্ব দেশে ইসলাম প্রচারে রওয়ানা হন তখন তাঁর মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবির (র) তাঁকে একমুঠো মাটি দিয়ে বলেছিলেন, স্বাদে, বর্ণে ও গন্ধে যেখানের মাটির সাথে এ মাটির মিল পাওয়া যাবে সেখানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করবে।

হযরত শাহজালাল (র) তাঁর একজন বিশিষ্ট শিষ্যকে মাটি পরীক্ষার ভার দেন, পরে তাঁর আসল নাম ছাপাবার নাম হয় ‘চাষনী পীর’। সিলেটের মাটির সাথে আরবের মাটি মিলে যায়। মুর্শিদের নির্দেশ মোতাবেক হযরত শাহজালাল (র) সিলেট শহরে বসতি স্থাপন করেন। কবি বলেছেন :

পুণ্য মক্কা ধূলি-

মাতুল কবির তোমার হাতেতে এক মুঠো দেন তুলি।

কহিলা, “যেখানে পাবে হেন মাটি সেখানে করিবে বাস

দ্বীন ইসলাম করিবে প্রচার এই মোর অভিলাষ।”

পীরের বচন করিয়া স্মরণ দিলে তুমি নির্দেশ

‘চাষনী পীর’ কে পরখিতে মাটি পথে পড়ে যত দেশ।

ভক্ত চাষনী পীর-

অবশেষে পেলেন সমতুল মাটি সুরমা নদীর তীর।

আরবের মাটি সিলেটের মাটি মিশে গেল একাকার

আজানের ধ্বনি উঠে রনরনি আল্লাহু আকবার।… (সংক্ষেপিত)

আমাদের সমাজ জীবনে হযরত শাহজালাল (র.)’র প্রভাব সীমাহীন। তাঁর জীবন কাহিনী নিয়ে দেশ‑বিদেশে কত শত পুথি-পুস্তক, গ্রন্থ‑কিতাব, গান‑গজল, প্রতিষ্ঠান, পথ‑প্রান্তর, সংঘ‑সমিতি, স্কুল‑কলেজ, মাদরাসা-মক্তব, শহর-উপশহর, একাডেমী-ইউনিভার্সিটির নামকরণ করা হয়েছে, এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে হাজার পৃষ্ঠার বই লেখা যেতে পারে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে তিনি ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র।

মন্তব্য

  • One of the unique gems of the entire sec­tion was Syed Mostafa Kamal in the lin­eage of Syed Nasir Uddin (Rh). We feel him deeply. May Allah Almighty place him in the high­est place of Jannat.

Leave a Reply to Muminul Haque