সৈয়দ বংশের ইতিবৃত্ত ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
(মশাজান সাহেব বাড়ীর সৈয়দ আবে তাহের সাহেবের সাথে আলাপচারিতার প্রেক্ষিতে লিখিত)
লেখকঃ- সৈয়দ হোসাইন উল হক। সুরাবই সাহেব বাড়ি, হবিগঞ্জ।
রুচিবোধের কারণেই, পারতপক্ষে কোনও ব্যক্তি বা বংশের নাম উল্লেখ করে কিছু বলি না। ব্যক্তির বা বংশের নাম ধরে টানাটানি করাটা নেহায়েত অপ্রযোজ্য রুচির ঠেকে। এমনকি প্রতিষ্ঠানের নাম ধরেও টানাটানি করি না।সংঘ‑সংগঠনের নাম চলেই আসে, এটুকু ঠেকানো যায় না। এবং সংঘ‑সংগঠনের নামও অন্য কারণে আসে না। মূলত আসে মতাদর্শের কারণে। আর মতাদর্শের নাম আসে স্রেফ সেটার ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে।না হলে, আল্লাহরই শপথ, আমরা এমনকি কোনও মতাদর্শ (ফির্কা, ইজম) নিয়েও কথা বলতাম না। না কথা বলতাম কোনও বংশ নিয়ে। সত্যবোধের উপলব্ধিতে ডুবে থাকা এতই মহৎ বিষয়, তাতেই শান্তি এবং তাতেই পরিণতি… সেখানে কোনও ধর্ম, মতাদর্শ, সংঘ‑সঙ্গঠনের নামই আসার কথা নয়, ব্যক্তির বা বংশের নাম তো আরো বহু পরে!কিন্তু ব্যক্তিরগুষ্টির বা বংশের নাম উল্লেখ করতে হল পরিস্থিতির সাপেক্ষে।
যাই হোক মূলবক্তব্যে আসি,
সৈয়দ অর্থ সর্বশ্রেষ্ঠ। ধর্মীয় ও সামাজিক দিক থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ বংশ।সৈয়দ বা স্যৈয়দ বা সাইয়্যেদ সায়্যিদ
ইংরেজি ভাষায়: Sayed also spelled Sayyid, Seyd, Syed, Saiyid, Seyed and Seyyed(আরবি ভাষায়: سيد; meaning Mister) (plural Sadah আরবি ভাষায়: سادة, Sādah) হল এমন একটি সম্মানসূচক উপাধি যা ধারা ইমাম আলী আ: এর ওরুসে এবং নবী নন্দিনী মা ফাতেমা (আ:) এর গর্ভে সন্তান ইমাম হাসান ও হোসাইনের (আ:)বংশধারার নবী মোহাম্মদ (সা:)বংশধরগণকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
নবী বংশ (আহলে বাইত) আ: ফযিলত’এর উপর ?ক্বুর’আনের আয়াত ও হাদিস’এ রসূল (স.):
১: আয়াতে তাতহীর:
إنما يريد الله ليذهب عنكم الرجس أهل البيت ويطهركم تطهيرا
হে রসূলের আহলেবাইত! আল্লাহ তোমাদের কে সমস্ত অপবিত্রতা জিনিস থেকে দুরে রেখেছেন, আর যেমন ভাবে পবিত্রতা রাখা উচিত তেমন ভাবে পবিত্র বানিয়েছেন।[1]
২: আয়াতে মুওয়াদ্দাত:
قل لا أسئلكم عليه أجرا إلا المودة في القربى
হে আমার রসূল! তুমি ওদের বলে দাও আমি তোমাদের কাছ থেকে কোন পারিশ্রমিক চাইনা শুধু আমার আহলে বাইত এর সাথে ভালবাসো(মুওয়াদ্দাত)।[2]
৩: আয়াতে মোবাহেলা:
(فَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ )
হে আমার রসূল বলে দাও তোমরা তোমাদের পুত্রদের নিয়ে এসো আমি আমার পুত্রদেরকে নিয়ে আসছি আর তোমরা তোমাদের মহিলাদের কে নিয়ে এসো আমি আমারদের মহিলাদেরকে নিয়ে আসছি আর তোমরা তোমাদের নাফসকে নিয়ে এসো আমি আমার নাফসকে নিয়ে আসছি, তার পর এক অপরের উপর বদ্দুওয়া ও আল্লাহোর লানাত মিথ্যাবাদিদের উপর পাঠায়।[3]
হাদিস ও রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, পুত্র’এর স্থানে হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হুসায়েন (আলায়হেমাস সালাম) ও মহিলার স্থানে মা’ফাতেমা (সালামুল্লাহ আলায়হা) ও রসূল (স.) এর আত্মার স্থানে হযরত আলি (আ.) কে নিয়ে গিয়েছিলেন।
মুসলিম শরিফের হাদিস:
(وَلَمَّا نَزَلَتْ هَذِهِ الْآيَةُ } فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ } [آل عمران: 61] دَعَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلِيًّا وَفَاطِمَةَ وَحَسَنًا وَحُسَيْنًا فَقَالَ: )اللهُمَّ هَؤُلَاءِ أَهْلِي(
যখন এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয় (فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ) তখন রসূল আল্লাহ (স.) আলি ও ফাতেমা, হাসান ও হুসায়েন (আলায়হেমুস সালাম) কে ডেকে বললেন: আল্লাহুম্মা হা’উলাই আহলি অর্থাত: হে আমার আল্লাহ এরাই আমার আহলে বাইত।[4]
আনা আলীউন মীন নুরী ওয়াহেদ”
“আমি ও আলী একখন্ড নুর হতে সৃষ্টি” -[5]
বংশ ধারা ছেলেকে দিয়ে মেয়েকে দিয়ে নয়।কিন্তু এর ব্যতিক্রম হয়েছে দুই জায়গায়।
১.হযরত ইমরানের কোন পুত্র সন্তান ছিল না।কন্যা হযরত মরিয়মের সন্তান হযরত ঈসা(আ:) কে ইমরানের পুত্র বলে কোরআনে ঘোষনা করা হয়েছে।[6]
২.বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (দ:) এর বেলায় একই ব্যতিক্রম হয়েছে।হযরত মোহাম্মদ (দ:) এর কোন পুত্র সন্তান ছিল না।কিন্তু মা ফাতেমা (আ:)এর দুই সন্তান ইমাম হাসান(আ:) ইমাম হোসাইন (আ:)কে নবী সন্তান বলে ঘোষনা করেছেন।?সুরা আল ইমরানের ৬১ নং আয়াতে নবীর সন্তান বলা হয়েছে। উনাদের থেকেই সৈয়দ বংশের যাত্রা শুরু।
ইমাম আলী ও মা ফাতেমা (আ:) ছিলেন মাসুম(নিষ্পাপ )।তাদের দুই সন্তানও ছিলেন মাসুম।কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ:) এর স্ত্রী মাসুম ছিলেন না।তার উরুসে ইমাম জয়নাল আবেদিন(আ:) মাসুম।এইভাবে চলতে থাকে ইমাম মাহদী (আ:) পর্যন্ত।সুতরাং মাতা নয় পিতার ঔরুস জাতই বিবেচ্য।ইমাম আলী আ: এর ওরুসে এবং নবী নন্দিনী মা ফাতেমা (আ:) এর গর্ভে সন্তান হাসান ও হোসাইনের বংশধারার নবী মোহাম্মদ (সা:)বংশধরগণকে সৈয়দ বলা হয়।উনাদের থেকেই শুরু হয় সৈয়দ বংশের যাত্রা।আরব দেশের বিখ্যাত বংশ “সৈয়দ” বংশ। এদেশে সৈয়দগন আরব ভুমি থেকে মুলত ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ আগমন।পরবর্তীতে এদেশে স্থায়ী হয়ে যান।তাদের বংশধরগন আজো আমাদের দেশে রয়েছেন।
আমাদের দেশেও এই বংশের কদর অনেক। জাত‑পাত আক্রান্ত ভারতীয় উপমহাদেশে সৈয়দদের শান্তির বানী মানুষদের উপকৃত করেছিল।রুট কানেকশন এবং ঐতিহ্য অনেক শক্তিশালী হওয়াতে একটা সময় সৈয়দ বংশের প্রাদূর্ভাব শুরু হয়।সৈয়দ যেহেতু মুসলিম উম্মার প্রবর্তকের বংশধারার উপাধী, একারনে মুসলমান সমাজে এই লকবটার ধর্মীয় এবং সামাজিক মূল্য আকাশচুম্বি। আর ধর্মীয় ও সামাজিক মর্যাদা প্রাপ্তি বা অর্জনের লোভ মানুষের স্বভাবজাত।
ফলে দেখা যায় ডানে সৈয়দ, বামে সৈয়দ, ঘড়ে সৈয়দ, বাইরে সৈয়দ.. সৈয়দ সৈয়দ আর সৈয়দময় (নকল সৈয়দ)।
কোন বংশের ছাওয়াল তুমি?বৃক্ষ তোমার নাম কি?
৩০০ মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।
হাহাহাহা,বলবেন হাঁসছি কেন?সুখ ‑দুঃখে সব মিলিয়েই একটু হাসালাম ।মানুষ যখন নিজের নামের প্রতি ভড়সা হারিয়ে ফেলে তখন তাকে বংশ পরিচয়ের মুখাপেক্ষী হতেই হয়। ১৪ পুরুষের নাম বেঁচে টিকে থাকার লড়াই চালাতে হয়, ১৪ পুরুষ ইতিহাসের সাক্ষী গোপাল হতে হয়।যার কুফল সরুপ দেখতে পাই সৈয়দদের নাম ব্যাবহার করে চুরি চামারী থেকে শুরু করে যৌতুক গ্রহণ, ব্যাভিচার, ডাকাতি, মহাজনী, সুদের কারবার সব কিছুতেই দেখা গেল সৈয়দ বংশীয়রা জড়িয়ে পরছে (নকল সৈয়দ)।
মহা বিপদ! স্বভাবগতভাবে তাদের আসল পরিচয় বেরিয়ে আসে যা সৈয়দ বংশীয়দের ধর্মীয় ওসামাজিক মর্যাদার পরিপন্থী নয়।
ছোটবেলায় একটি গল্প মনে পড়ে গেল জানিনা এর সত্যতা তবে তখন খুব মজা পাইছিলাম।দাঁড়ান বলি সেই মজার ঘটনাটা:-
যখন ডানে সৈয়দ, বামে সৈয়দ, ঘড়ে সৈয়দ, বাইরে সৈয়দ.. সৈয়দ সৈয়দ আর সৈয়দময় এমন সময় আরব প্রশাসন শুদ্ধী অভিজান চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহন করে।ঘোষনা আসে জুম্মার দিনে বিশেষ মাঠে, সকল সৈয়দ একত্রীত হবে সব সৈয়দ বিশেষভাবে প্রস্তুত আগুনের গোলকের ভেতর দিয়ে লাফ দেবে। অনেকটা সার্কাসপার্টির ফায়ার জাম্পের মত।
সৈয়দদের ওপর আল্লার আদ্ধাত্মিক আনুকুল্য আছে তাই আগুনের গোলকে তাদের কোন ক্ষতি হবে না। এপার থেকে অন্য পারে লাফ দেবার পরেও, আইরন করা জিব্বাতে ভাজ পড়বে না।নির্দিষ্ট দিনে দেখা গেল অর্ধেকের বেশী সৈয়দ মাঠে অনুপস্থীত। বেত্রাঘাতের ভয়ে, আগুনে ঝলসানোর ভয়ে পাগারপার….।
যারা অগ্নি গোলক খেলতে আসে নাই তাদের আর কক্ষনোই আরবের মাটিতে দেখা যায়নি।এভাবেই আরবে জেনেটিক্যালি শুদ্ধ সৈয়দ প্রতিষ্ঠালাভ করে।
প্রায় দেড় হাজার বছর আগের এই বংশের সাথে কোনা যোগসূত্র না থাকলেও বাংলাদেশের অনেক মুসলমান পরিবার (নকল সৈয়দ পরিবার)সৈয়দ বংশ পদবী ব্যবহার করে নিজেদের সম্ভ্রান্ত ও কুলীন মুসলমান বলে দাবি করে থাকেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে সৈয়দ পদবীর অপব্যবহার ও পক্ষেপণ ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। প্রকৃত পক্ষে সৈয়দ নন এবং পারিবারিক কোন কুলীন পদবীও নেই, অথবা পূর্ব পদবী ঐতিহ্য পরিত্যাগ করতে ইচ্ছুক এমন অনেক বংশ গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বিশেষে বাংলাদেশে সৈয়দ পদবী আরোপিতভাবে ব্যবহার শুরু করেছে। প্রচুর বাঙালি মুসলমান রয়েছে যারা পূর্ব ঐতিহ্যগত ভাবে সৈয়দ নন, অথচ তাদের নামের পূর্বে পদবীর ব্যবহার শুরুকরে দিয়েছেন।কেউ কেউ আবার পরিচয়বাহী সংক্ষিপ্ত শব্দ বা শব্দ গুচ্ছ যথা ‘এস-এম’ যুক্ত করে থাকেন। বস্তুত এস.এম হচ্ছে ‘সৈয়দ মোহাম্মদ’ অথচ ব্যবহারকারীরা অনেক সময়ই তা পুরোপুরি ভেঙে লেখেন না হয় তো ভয়ের কারণে।
ঐতিহ্যকে ধারন ও লালন করাও মানুষের আরেকটা বৈশিষ্ট। আর এসব কারনেই যখন মানুষ অর্থবিত্ত শিক্ষা সহ যাবতীয় দিক দিয়ে সচ্চল হয়ে যায়, তখন তার মধ্যে সম্মান ও ঐতিহ্যের একটা ম্পিহা কাজ করে। সম্মান জিনিসটা তার প্রচেষ্টা দ্বারা অর্জন করে নিতে পারলেও ঐতিহ্য জিনিসটা তার পক্ষে কোন ভাবেই অর্জন করা সম্ভব নয়। আর এ সমস্যা থেকে উত্তোনের জন্যই সে যে কোন কায়দায়ই হোক সৈয়দ লকবের দিকে হাত বাড়ায়।
সৈযদ লকব প্রহৃত হওয়ার আরেকটা সাম্প্রতিক কালের বড় কারন পিরগিরি বা সাধুসন্ত পেশায় সহজ ও উচ্চমান প্রভাব।
উসমানিয়া খেলাফতি যুগে মাতৃরিস্তায় সৈয়দ লকব ধারনকে একে বারে বৈধ করে দেয়া হয়েছিল। সৈয়দ বেড়ে যাওয়ার এ আরেক কারন।যার ফলে সৈয়দ বংশে বিবাহ করে তার সন্তান থেকে সৈয়দ লিখা শুরু করে দেন।তাদের ভাষ্য হল মা থেকে সৈয়দ বংশ শুরু ।কিন্তু ধর্মীয় ও সামাজিক ইতিহাস বলে অন্য কথা।বংশ কখনো মা থেকে শুরু হয় না সব সময়ই বাবা থেকে।বংশ সিজরাগুলো উল্টালে দেখতে পাই আজ নয় আদিকাল হতেই পিতা থেকে বংশ ধারা প্রবাহিত।মুলত মাওলায়ে কায়নাত ইমাম আলী (আ:) থেকেই সৈয়দ বংশের শুরু(স্বীকৃত)।
কেউ কেউ আবার সৈয়দ বাড়ির আশে-পাশে বসবাস করতেন পরে অন্যত্র চলে গিয়ে সৈয়দ লিখাচ্ছেন। শুধু সৈয়দ আর সৈয়দ,মুল খুঁজলে কিছুই মিলে না সব নকল।
বাঙালির বংশ পদবীর ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। মধ্যযুগে সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার ফলে পরবর্তীতে বৃটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমান্তরালে বাঙালির পদবীর বিকাশ ঘটেছে বলে মনে করা হয়।
বাঙালির জমি- জমা বিষয় সংক্রান্ত কিছু পদবী যেমন- হালদার, মজুমদার, তালুকদার, পোদ্দার, সরদার, প্রামাণিক, হাজরা, হাজারী, মন্ডল, মোড়ল, মল্লিক, সরকার, বিশ্বাস ইত্যাদি বংশ পদবীর রয়েছে হিন্দু ‑মুসলমান নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের একান্ত রূপ। বাঙালি মুসলমানের শিক্ষক পেশার পদবী হলো-খন্দকার, আকন্দ, নিয়াজী ইত্যাদি। আর বাঙালি হিন্দুর শিক্ষক পদবী হচ্ছে দ্বিবেদী, ত্রিবেদী, চর্তুবেদী ইত্যাদি।
বাঙালির আরও কিছু বিখ্যাত বংশ পদবীর যেমন‑শিকদার, শেখ, মীর, মিঞা, মোল্লা, দাস, খন্দকার, আকন্দ, চৌধুরী, ভুইয়া, মজুমদার, তরফদার, তালুকদার, সরকার, মল্লিক, মন্ডল, পন্নী, ফকির, আনসারী, দত্ত ইত্যাদি।
বিশেষ করে মীর,খন্দকার,শাহ শেখ,মিঞা,ফকির,শিকদার ছিলেন তারাও সৈয়দ লিখা শুরু করে দিয়েছেন। শুধু সৈয়দ আর সৈয়দ,মুল খুঁজলে কিছুই মিলে না সব নকল। এবার দেখা যাক উগরোক্ত পদবীগুলোর ইতিহাস কি বলে:-
শিকদারঃ সুলতানি আমলে কয়েকটি মহাল নিয়ে গঠিত ছিল এক একটি শিক। আরবি শিক হলো একটি খন্ড এলাকা বা বিভাগ। এর সাথে ফারসি দার যুক্ত হয়ে শিকদার বা সিকদার শব্দের উদ্ভব হয়েছে। এরা ছিলেন রাজস্ব আদায়কারী রাজকর্মচারী। শব্দকোষে যাকে বলা হয়েছে শান্তিরক্ষক কর্মচারী। এরা শিক বন্দুক বা ছড়ি বন্দুক ব্যবহার করতো বলে শিকদার উপাধী পেয়েছিল; সেই থেকে বংশ পরমপরায় শিকদার পদবীর বিকাশ ঘটে।
শেখঃ শেখ আরবি থেকে আগত পদবী। সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের সম্মানসূচক বংশ পদবী শেখ। যিনি সম্মানিত বৃদ্ধ অথবা যিনি গোত্র প্রধান, তাকেই বলা হতো শেখ। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) সরাসরি যাকে বা যাঁদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন, তিনি বা তার বংশ ধরও শেখ নামে অভিষিক্ত হতেন অথবা শেখ পদবী লাভ করতেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে যারা শেখ পদবী ধারণ করেন, তারা এ রকম ধারণা পোষণ করেন না যে, তারা বা তাদের পূর্ব পুরুষরা এসেছিলেন সৌদী আরব থেকে। বাঙালি শেখ পদবী গ্রহণের নেপথ্যে রয়েছে ঐ পূর্বোক্ত চেতনা। নবীর হাতে মুসলমান না হলেও বাংলায় ইসলাম ধর্ম আর্বিভাবের সাথে সাথে যারা নতুন ধর্মকে গ্রহণ করে নেন; নও মুসলমান’ হিসেবে প্রাচীন ও মধ্যযুগে তারাই শেখ পদবী ধারণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাদের বংশের উত্তর সূরীরাই শেখ পদবী ব্যবহার করে এসেছেন। এমনিতে অন্য ধর্মের লোকের কাছে মুসলমান মানেই শেখ বা সেক। কেউ কেই শেখ কেউ সেক কিংবা কেউ বা শেখ এর রূপান্তর শাইখও ব্যবহার করে থাকেন।
মীরঃ মির বা মীর শব্দটি এসেছে আরবি থেকে। আরবি শব্দ আমীর’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে মীর। সেই অর্থে মীর অর্থ দলপতি বা নেতা, প্রধান ব্যক্তি, সরদার ইত্যাদি। জিতে নেয়া বা জয়ী হওয়া অর্থে মীর শব্দের ব্যবহার হতো। তবে মীর বংশীয় লোককে সম্ভ্রান্ত পদবীধারীর একটি শাখা বলে গাবেষকরা মনে করেন।
মিঞাঃ মিঞা মুসলিম উচ্চ পদস্থ সামাজিক ব্যক্তিকে সম্বোধন করার জন্য ব্যবহৃত সম্ভ্রম সূচক শব্দ। এক অর্থে সকল মুসলমানের পদবীই হচ্ছে মিঞা। বাঙালি হিন্দুর মহাশয়’ এর পরিবর্তে বাঙালি মুসলমান মিয়া শব্দ ব্যবহার করে থাকে। মিঞা’ শব্দটি এসেছে ফারসি ভাষা থেকে। প্রভু বা প্রধান ব্যক্তি বুঝাতেও মিয়া শব্দের প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তবে গ্রামীন প্রধান বা সর্দার অর্থের মিঞা পদবী হিসেবে বাঙালি মুসলমান সমাজে ঠাঁই পেয়েছে।
খন্দকারঃ মুসলিম সমাজের ফারসি শিক্ষক হিসেবে খোন্দকার বা খন্দকারের পরিচয় পাওয়া যায়। অন্য দিকে খোন্দকারের ‘ পদবী এসেছে সামন্ত সমাজ থেকে পেশাজীবী হিসেবে। সাধারণ ভাবে খোন্দকার বা খন্দকার অর্থ হচ্ছে কৃষক বা চাষাবাদকারী । মনে করা হয় ফারসি কনদহ ‘ এর যার অর্থ কৃষি’সাথেকার যুক্ত হয়ে কনদহকার> খনদহকার>খন্দকার হয়েছে। ভিন্ন মতে, খন্দকারের মূল উৎপত্তি সংস্কৃত কন্দ> খন্দ যার অর্থ ফসল বলা হয়েছে। এই খন্দ এর সাথে কার যুক্ত হয়েও খন্দকার> খোন্দকার হতে পারে। এবং এতেও পূর্বের খন্দকার’ শব্দের উৎসের অর্থের তারতম্য ঘটছে না। আবার ফারসি ভাষায়, খোন্দকার বলে একটি শব্দ আছে যার অর্থ শিক্ষক। সেখান থেকেও খোন্দকার পদবী আসা বিচিত্র কিছু নয়। অথবা খোন্দকার শব্দের যে ভিন্নভিন্ন অর্থ তার সবগুলো মিলিত তাৎপর্য থেকেই বিভিন্নভাবে খন্দকার পদবীর উৎপত্তি হয়েছে।
শাহ ফকিরঃ মুসলমানদের মধ্যে সন্ন্যাসবৃত্তি’ থেকেই এসেছে শাহ ফকির’ পদবী। মরমী সাধকরা গ্রহণ করতেন শাহ ফকির’ পদবী। এটি আরবি শব্দ, যার মূল অর্থ নি:স্ব। আবার আরবি ফকর শব্দের অর্থ দারিদ্র। এ থেকে ফকির শব্দের উৎপত্তি। ফকির এবং পার্শি দরবেশ ব্যক্তিগণ সাধারণত এদেশে শাহ ফকির নামে পরিচিত। বিশেষ কোন ধর্ম মতের একান্ত অনুসারী না হয়ে যারা সকল ধর্মের মূলনীতি নিয়ে আত্মতত্ত্বের সন্ধান করেন তাদেরকেও শাহ ফকির বলা হয়। আবার সুফি বা বাউল তত্বের ধারকরাও শাহ ফকির লেখেন।
যাইহোক উপরোক্ত আলোচনা থেকে একটা বিষয় ক্লিয়ার উনারা সম্ভান্ত্য পরিবার কিন্তু সৈয়দ পদবীর সাথে কোন যোগসুত্র পাওয়া যায় না।এরকম শতাধিক বংশ পদবী রয়েছে আমাদের দেশে। বাঙালির পদবীর ইতিহাস বৈচিত্র পথ ও মতের এক অসাধারণ স্মারক হিসেবে চিহিৃত। আমার পশ্ন তবে কেন উনারা সৈয়দ হওয়ার এত খায়েস?চলমান কালে সৈয়দ লকব প্রহৃত হওয়ার সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে একটি মতলবি ও মিথ্যা প্রচারনা, সেটা হল- সৈয়দ লকব অর্জনযোগ্য।অথচ সৈয়দ হচ্ছে বরাবরই একটা বংশ বা রক্ত পরম্পরা লকব।
বিভিন্নভাবে কাগজপত্র তৈরী করে সিজরা বানিয়ে বিভিন্ন পথ ধরে বিভিন্ন সুএ ধরে নকল সৈয়দ লকবের বৃথা প্রবণতা।এই বৃথা সময় নষ্ট না করেও সততাও ইলমের মাধ্যমে সৈয়দের স্থানে যাওয়া যায়।বিখ্যাত সাহাবী হযরত সালমান ফার্সী প্রতি নবী (দ:)এতই সন্তুষ্ট ছিলেন যে বলতে বাধ্য হয়েছেন “সালমান মিন্নি আহলে হাইতি”অথ্যাৎ সালমান আহলে বাইতের অন্তভুক্ত।অনেক বড় সম্মান পেয়েছিলেন তিনি।
আমার পরদাদা হযরত শাহ সুফি সৈয়দ মোহাম্মদ ঈসমাইল (রহ:) এর খলিফা মজ্জুব ওলী যিনি “দরঘা পুতি “নামে খ্যাত ছিলেন(পুরাসুন্দা গ্রামের নিবাসী )।যিনি তার সমস্ত সম্পত্তি হযরত শাহ কারার (ফুলশাহ) রহ: দরঘার নামে ওয়াক্ফ করে এখানে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। আমাদের পরিবারের মুরিদ হওয়া শর্তেও উনাকে আমার বাপ‑চাচারা কদম বুচি করতেন।তিনি আপন কর্ম এ ইলমের দারা সম্মানের অধিকারী হন।এর জন্য উনাকে সৈয়দ লকব লাগাতে হয়নি।
কয়েক বছর আগের ঘটনা। আমি তখন আমাদের বাড়িতে(সুরাবই সাহেব বাড়ি,দরবার শরীফ,হবিগঞ্জ) অবস্খান করছিলাম। পরের দিন জাতীয় নির্বাচন।কি কারনে যেন ভোটার তালিকা আমার হাতে আসল,পড়তে শুরু করলাম।মনে হচ্ছিল ভোটার তালিকা নয় কোন সৈয়দ বংশের নসব নামা (বংশ সিজরা)পড়ছি।তালিকায় ডানে ‑বামে,উপরে-নিচে শুধু সৈয়দ আর সৈয়দ,যেন সৈয়দ এর বাজার।আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার দাদার শিষ্য মরহুম ভিংরাজ পুতি বলছিল “বাবারে আপনারা এক ঘর সৈয়দ ছিলেন কোন আপন লোক ছিল না, আজ আপনাদের আশে-পাশে ঘরে ঘরে নিজের লোক।ভালই হইছে ধরবন বাড়ছে”।
সৈয়দ কোন জাদুবিদের লকব নয় রে ভাই, সৈয়দ হল ধার্মিকের লকব। আর ধর্ম তথা আধ্যাতিকতার সাথে কেরামতির যে যোগসূত্র সেটার এখতিয়ার সযং স্রষ্টার। এখানে আসলে সাধকের এখতিয়ার নেই। স্রষ্টাই তাঁর নিকটতম উপাসককের মর্যাদাপ্রকাশ বা জাহের করার জন্য বা কোন বিপদ থেকে রক্ষার জন্য কিংবা কোন ব্যাক্তি বা গুষ্টিকে বিপদমুক্ত করা বা বিপদগ্রস্থ করার উছিলা হিসাবে তাঁর যখন ইচ্চা, যেভাবে ইচ্ছা, যতটা ইচ্ছা তাঁর সেই প্রিয় বান্দার মাধ্যমে আরুপ করেন।
হাদীসে আছে :-যারা নকল সৈয়দ অর্থাৎ সৈয়দ না হয়েও নামের আগে সৈয়দ লেখান তাদের শেষ বিচারের দিন জিহ্বার কেটে ফেলা হবে।
রসূল পাক (স.) ইরশাদ করেন:-যে বংশ তথা পৃত্রিপরিচয় গুপন করবে কিংবা নিজ পিতাকে অস্বীকার করে অন্যের পিতাকে নিজ পিতা ম্বাব্যস্থ করে নিজ বংশের দাবী করে,তাদের উপড়ে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত,ফেরেশতাকুল, মনুষ্যকুলের অভিশাপ্ত।
রোজ কিয়ামতে মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জের তাদের ফরজ,নফল কোন ইবাদতই কবুল করবেন না।[7]
সৈয়দ না হতেও যারা সৈয়দ লিখেন সময় থাকতে সাবধান হওয়া উচিত।এর পরিনাম খুব খারাপ ও ভয়াবহ।এ দেশ কেন সারা বিশ্বেই কিছু কিছু ইতিহাস বংশপরস্পরায় মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে।যার কোন লিখিত দলীল নেই।ঠিক আমরা সৈয়দগনের ইতিহাস লিখি আর নাই লিখি হাজার বছর মুখে মুখে যে ইতিহাস রচিত হয়ে আসছে তার থেকে এ দেশ তথা সারা বিশ্বর মানুষ জানে কারা সৈয়দ আর কারা সৈয়দ নয়।
তথ্যসূত্র:-
[1]. সুরায়ে আহজাব, আয়াত ন. ৩৩।
[2]. সুরায়ে শুরা, আয়াত ন. ২৩।
[3]. সুরায়ে আলে ইমরান, আয়াত ন. ৬১।
[4]. সহি মুসলিম, খ: ৪, প্র: ১৮৭১, হা: ।
[5].সহী বুখারী।
[6]সুরায়ে আল ইমরান।
[7]সহী বুখারী ও সহি মুসলিম।
Ho, Engseng. 2006. Graves of Tarim. University of California Press. Berkeley. p. 149
Sayyids and Sharifs in Muslim Societies: The Living Links to the Prophet, (আইএসবিএন৯৭৮-০-৪১৫৫-১৯১৭‑৫ সংস্করণ)। pub. Routledge,। ২০১২। পৃ: ed. Kazuo Morimoto,।
Encyclopaedic Ethnography of Middle-East and Central Asia: A‑I, Volume 1 edited by R. Khanam
সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন(রহ:) সিলেট ও তরফ রাজ্য বিজয়ী-ডা: এস এম ইলিয়াছ
ভারনাকুলার এডুকেশন ইন বেঙ্গল (১৯০০)-নওয়াব বাহহদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী।
সিলেটঃ ইতিহাস ঐতিহ্য ডঃ শরিফ উদ্দীন আহমদ, (শামস উদ্দীন আহমদ লিখিত প্রবন্ধ – মুসলিম শাসন ব্যবস্থা), ২০৯ পৃঃ, গ্রন্থ প্রকাশনায়- বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, প্রকাশকাল ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ ।
তরফ বিজেতা সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন ও মুড়ারবন্দ দরগাহ শরিফ। সৈয়দ মোস্তফা কামাল। প্রকাশনায়-সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন স্মৃতি পরিষদ মুড়ারবন্দ দরগাহ শরিফ। প্রকাশ কাল জানুয়ারি ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ
শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ, দ্বিতীয় ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড, পঞ্চম অধ্যায়, তরফের কথা গ্রন্থকার – অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি; প্রকাশক: মোস্তফা সেলিম; উৎস প্রকাশন, ২০০৪।
ইসলাম জ্যোতি, মুফতি আজহারুদ্দীন সিদ্দিকি, উত্স প্রকাশন ঢাকা, প্রকাশকাল সেপ্টেম্বর ২০০২, পরিদর্শনের তারিখ: ২৯ আগষ্ঠ ২০১১
মতামত দিন